শতবর্ষের
আলোয়
রবীন্দ্রনাথের
নোবেল পুরস্কার বিজয়ের কাহিনী
---- ফিরে
দেখা
প্রেমানন্দ
ঘোষ
১৯১৩
সালের ১৩ই নভেম্বর দিনটি বাংলা
তথা ভারতের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে
লেখা থাকবে। ১৯১৩ সালের সাহিত্যে
নোবেল পুরস্কারের জন্য ঐদিন
ঘোষিত হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের
নাম। যে সাহিত্য এই পুরস্কারের
জন্য বিবেচিত হয় তার নাম
“Gitanjali, Song Offerings”।
বইটি কবির গীতাঞ্জলী এবং
অন্যান্য কয়েকটি কাব্যের
সঙ্কলিত কিছু কবিতার ইংরাজি
অনুবাদ।
আমাদের
মনে রাখতে হবে এশিয়া মহাদেশে
তিনিই প্রথম বিশ্বখ্যাত নোবেল
পুরস্কার পেলেন। এই সম্মান
লাভ বিংশ শতকের ইতিহাসে প্রাচ্য
ভূখণ্ডের এক তাৎপর্য পূর্ণ
ঘটনা। কেননা তখন বিশ্বে
ব্রিটিশদের একাধিপত্য। তার
রাজ্যে সূর্য অস্ত যায় না।
ইউরোপের অন্যান্য দেশও এশিয়া,
আফ্রিকা, আমেরিকা
প্রভৃতি মহাদেশে উপনিবেশ গড়ে
তুলে নিজেরা বিত্তবান ও
ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছে। শিল্প,
শিক্ষা, সাহিত্য,
সংস্কৃতি, বিজ্ঞান,
প্রযুক্তিবিদ্যা,
সামরিক, অর্থনৈতিক,
রাজনৈতিক প্রভৃতি
সকল বিষয়ে তারা অগ্রণী। কুলীন
ও মহাশক্তিধর ইউরোপের রাজ-দরবার
থেকে প্রায় অজ্ঞাত ও অখ্যাত
এক বাঙালি কবির সাহিত্যে নোবেল
পুরস্কারের প্রাপ্তি সকলকে
বিস্ময়াবিষ্ট করে তুললো।
বাংলা তথা ভারতের সাহিত্য ও
সংস্কৃতি গৌরবান্বিত হোল।
পাশ্চাত্য মুখ ফেরালো প্রাচ্যের
দিকে। কবি সত্যেন্দ্রনাথ
দত্ত লিখলেন,
“জগৎকবির সভায় মোরা তোমার করি গর্ব।/
বাজ্ঞালি আজ গানের রাজা বাজ্ঞালি নহে খর্ব”।
“জগৎকবির সভায় মোরা তোমার করি গর্ব।/
বাজ্ঞালি আজ গানের রাজা বাজ্ঞালি নহে খর্ব”।
অতুল প্রসাদ গাইলেন,
“বাজিয়ে রবি তোমার বীণে, আনল মালা জগৎ জিনে /
তোমার চরনতীর্থে মাগো জগৎ করে যাওয়া আসা”।
“বাজিয়ে রবি তোমার বীণে, আনল মালা জগৎ জিনে /
তোমার চরনতীর্থে মাগো জগৎ করে যাওয়া আসা”।
পাঠক
স্মরন করুন, এই
ঘটনার বিশ বছর আগে এক নবীন
সন্ন্যাসীর পাণ্ডিত্যে ও
বাগ্মিতায় বিশ্ববাসী মুগ্ধ
হয়েছিলেন। ১৮৯৩ সালের ১১ই
সেপ্টেম্বর বাংলা তথা ভারতের
ইতিহাসে প্রথম গৌরবোজ্বল
দিনটি ক্ষোদিত হয়েছিল। মাত্র
ত্রিশ বছর বয়সে স্বামী বিবেকানন্দ
সেদিন আমেরিকার শিকাগো শহরে
বিশ্বধর্ম সম্মেলনে বিনা
নিমন্ত্রনে যোগ দিয়ে সত্যদ্রষ্টা
ঋষির মতো ভারতের সনাতন
হিন্দুধর্মের আদর্শের কথা
তুলে ধরে গর্বোদ্ধত আমেরিকা
ও ইউরোপ -বাসীদের
মন্ত্রমুগ্ধ করে দিয়েছিলেন।
হিন্দুধর্মের উদারতা,
সরলতা, আতিথেয়তা
ও বিশ্বমানবতার কথা তারা
শুনলেন এবং অভিভূত হলেন।
হতদরিদ্র, কুসংস্কারাচ্ছন্ন,
অশিক্ষিত, অসভ্য
ভারতবাসীর বদনাম ঘুচলো।
রবীন্দ্রনাথ
কলকাতার জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত
ঠাকুর পরিবারের মহর্ষি
দেবেন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ পুত্র।
আর বিবেকানন্দ তথা গৃহী
নরেন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকোর
নিকটস্থ সিমলার এটর্নি বিস্বনাথ
দত্তের জ্যেষ্ঠ পুত্র। কলকাতার
বাসিন্দা এই দুই ব্যাক্তির
একজন ধর্মে অন্যজন সাহিত্যে
বিশ্বের দরবার থেকে বিজয়মাল্যে
ভূষিত হয়েছিলেন। স্বামীজিকে
অলক্ষ্যে প্রেরণা যুগিয়েছেন
তাঁর গুরু, আর
কবিকে তাঁর জীবন দেবতা।
১৯০২
সালের ২৩সে নভেম্বর কবিপত্নী
মৃণালিনী দেবী দেহত্যাগ করেন।
কবির তখন বয়স প্রায় ৪২ বছর।
পত্নীর মৃত্যুতে কবি ব্যাথা
পেলেন ও নিঃসঙ্গ হয়ে গেলেন।
স্ত্রীর মৃত্যুর পর কবিকে
দেখার কেউ নাই। তাঁর কাজের
বিরাম নাই। লেখা চলছে, আশ্রম
বিদ্যালয়ের কথা ভাবছেন।
সন্তানদের কথা ভাবতে হয়। মাঝে
মাঝে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়তে
বাধ্য হচ্ছিলেন। শরীর আর মনের
উপর প্রবল চাপ। ফলে বছর আষ্টেকের
মধ্যে শরীর গেল ভেঙ্গে। চিন্তিত
হলেন পরিজনেরা। ডাক্তার বায়ু
পরিবর্তনের পরামর্শ দিলেন।
কবি ঠিক করলেন শিলাইদহের কুঠি
বাড়িতে কিছুদিন থাকবেন।
শিলাইদহের
কুঠি বাড়ির ছাদের ঘরে কবির
সময় কাটে। অনুবাদের কাজ করেন।
মাঝে মাঝে আসেন এক সহজিয়া
বৈষ্ণবী সাধিকা। তাঁর সঙ্গে
ধর্ম আর তত্ত্বকথা আলোচনা
করে কবি আনন্দ পেতেন। তাঁর
গল্পে সেই বৈষ্ণবীকে তিনি
অমর করে গেছেন। তাঁর সাহচর্যে
সে সময়ে কবির মনে যে ধর্ম-ভাবনার
স্ফুরণ ঘটে তার প্রভাব পড়েছে
সে সময়ে অনুদিত ইংরাজি
কবিতায়।
বৈষ্ণবী
তাঁকে সাহায্য করতেন কবিতা
নির্বাচনে ও অনুবাদে। শিলাইদহের
নির্জন আকাশে এবং সর্ষেখেত
ও বালুচরের পটভূমিকায় এবং
বৈষ্ণবীর সহজিয়া তত্ত্বের
আলোকে কবিতাগুলি কবির নতুন
সৃষ্টি হয়ে উঠে। ইংরাজি
গীতাঞ্জলীর ভুমিকায় কবি
ইয়েট্স যথার্থ লিখেছেন
কবিতাগুলি নদী প্রান্তর থেকে
এসেছে।
শিলাইদহে
কবির স্বাস্থের কিছুটা উন্নতি
হলে বিলেত যাওয়া স্থির করলেন।
সঙ্গে পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও
পুত্রবধূ প্রতিমাদেবী। তাঁর
অনুবাদের খাতায় তখন ১০৩ টি
কবিতার সংকলন। তার মধ্যে
গীতাঞ্জলীর ৫৩ টি। বাকি ৫০
টির মধ্যে নৈবেদ্যর ১৫ টি,
খেয়ার ১১ টি। গীতিমাল্যের
১৬ টি, শিশুর ৩ টি
এবং চৈতালি, স্মরন,
কল্পনা, উৎসর্গ
ও অচলায়তন থেকে ১ টি করে। মোট
১০৩ টি কবিতার
সংকলনের নাম হল “Gitanjali, Song
Offerings”। অনুবাদের সময়
কবির মন বিশেষ এক ভাবনার মধ্যে
নিহিত ছিল। সকলের কাছে যা সহজ,
সুন্দর, প্রেমময়
ও কল্যাণপ্রদ সেই ভাবই মানুষ
প্রকৃতি ও ঈশ্বর ভাবনার মধ্যে
একীভূত হয়ে গেছে। সর্বধর্মের
সমন্বয় ঘটেছে তার অনুবাদে।
ইংরাজি কবিতাগুলি বাংলা কবিতার
আক্ষরিক অনুবাদ নয়। শিলাইদহে
কবিমনের নতুন ফসল। এগুলি গদ্যে
রচিত হোলেও কাব্যধর্ম ক্ষুণ্ণ
হয় নাই। তবে রসের দিকটা কম,
ভাবের দিকটা বেশী।
মূল রচনার অনুবাদে এরকম হওয়াটাই
স্বাভাবিক। কবি অনুবাদে
বাইবেলের সমধর্মী প্রাচীন
ইংরাজি ভাষার ব্যাবহার করেছেন।
“How thou singest my master. Thou art the sky. O thou
beautiful. I know not how thou singest -------” ইত্যাদি।
কবি
লন্ডনে পৌঁছলেন ১৯১২ সালের
১৬ ই জুন। লন্ডনে পরিচিতদের
মধ্যে ছিলেন চিত্রশিল্পী
উইলিয়াম রোদেনস্টাইন। তিনি
সাহিত্যরসিক এবং দার্শনিক।
১৯১০ সালে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে
অবনীন্দ্রনাথের চিত্রশালা
দেখতে গেলে সেখানে কবির সঙ্গে
তাঁর পরিচয় হয়। ভাষার অন্তরায়
সেদিন বাংলাদেশের একজন প্রধান
কবির কবিতা পাঠ থেকে তাঁকে
বঞ্চিত করেছিল। লেখা পড়তে না
পারলেও দুজনের মনের মিল হ’ল
খুব। সেই থেকে দু’জনের চিঠি
লেখালেখি চলত। ১৭ই জুন কবি
রোদেনস্টাইনের কাছে পাণ্ডুলিপি
পাঠিয়ে দেন। কবিতাগুলি পড়ে
তিনি খুব আনন্দ পান। তাঁর মনে
হয়েছিল কবিতাগুলি সম্পূর্ণ
নতুন ধরণের এবং কবি মহান মিস্টিক
কবিদের সমপর্যায়ভুক্ত। তিনি
ভাবলেন ‘এই মুক্তারাশির মর্ম
আমি কি বুঝব’ – সেইজন্য
পাণ্ডুলিপির তিনটি কপি করে
এ সি ব্রাডলি, স্টপফোর্ট
ব্রুক ও তখনকার শ্রেষ্ঠকবি
ডব্লিউ বি ইয়েট্স – এর কাছে
পাঠিয়ে দেন। প্রথম দু’জন রচনার
উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে শিল্পীকে
চিঠি দেন। ইয়েট্স কবিতাগুলি
পড়ে এতই মুগ্ধ হলেন যে, তাঁর
পল্লীনিবাস থেকে রবীন্দ্রনাথকে
দেখবার জন্য লন্ডনে ছুটে এলেন।
দুই কবির মিলনে প্রাচ্য ও
পাশ্চাত্যের মিলনের বীজ রোপিত
হল। তখন থেকেই প্রাচ্যের কবির
প্রতি ইয়েট্স শ্রদ্ধাবান
হয়ে উঠলেন।
৩০ শে
জুন রোদেনস্টাইনের উদ্যোগে
তাঁর বাড়িতে অনুদিত কবিতাগুলি
ইয়েট্স ভাবগম্ভীর পাঠ করেন।
উপস্থিত ছিলেন সাহিত্যিক,
কবি, সাংবাদিক,
স্থপতি, বৈজ্ঞানিক,
দার্শনিক প্রভৃতি
সমাজের বিভিন্ন পেশার মননশীল
মানুষ। সকলেই কবিতাগুলির
ভূয়সী প্রশংসা করেন। সি এফ
এন্ড্রুজের প্রতিক্রিয়া –
“ইয়েট্সের মুখে কবিতাপাঠ
শুনে তাঁর মন আনন্দে ভ’রে
গেছে, তাঁর খুব
ভালো লেগেছে – জগৎ পারাবারের
তীরে শিশুরা করে খেলা – ‘children
have their play on the seashore of worlds’।
রবীন্দ্র-কাব্যের
মদিরা তাঁর মনে নেশা ধরিয়ে
দিয়েছে। তাঁর অনুভুতি তখন
চ্যাপমান কৃত হোমারের অনুবাদ
পড়ে কবি কীট্সের অনুভূতির
মতো – “আমি যেন জ্যোতির্বিদ,
দূর লক্ষ্যে ভেসে
এলো কোন এক অচেনা গ্রহের দূরাগত
আলো”। সুলেখিকা মে সিনক্লিয়ার
অভিনন্দন বার্তায় লেখেন,
“কবিতাপাঠ শুনে
তিনি এতই অভিভূত হন যে, কোনো
কিছু বলার মতো অবস্থা তখন
ছিল না।
তাঁর
কবিতা হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো
তাঁর অন্তরাত্মাকে উজ্জীবিত
করেছে, জীবনবোধের
প্রত্যয়কে দৃঢ় করেছে। তিনি
ইংরেজ মরমিয়া কবিদের অতিক্রম
করে গেছেন। কবির সাবলীল ও সরল
ভাষায় তিনি পুর্ন তৃপ্তি
পেয়েছেন”। কবি মনীষী স্টপফোর্ড
বিচিত্রের পূজারী ছিলেন।
তিনি বলেন, ‘তোমার
কবিতাগুলিতে কোনো ধর্মের
কোনো creed-এর কোনো
গন্ধ নাই; এগুলি
আমাদের দেশের লোকের বিশেষ
উপকারে লাগবে বলে আমি মনে
করি’।
অভিভূত
মে সিনক্লেয়ার সিসেম ক্লাবে
এক সান্ধ্যভোজে কবিকে নিমন্ত্রণ
করেন। সেখানে বহু সাহিত্যিকের
মধ্যে বার্নার্ড শ উপস্থিত
ছিলেন। কেমব্রিজের অধ্যাপক
ডিকেনসনের আমন্ত্রনে তাঁর
বাড়িতে গেলে সেখানে বার্ট্রান্ড
রাসেলের সঙ্গে আলাপ হয়। তাঁরা
রবীন্দ্রনাথের কবিতা পাঠ
শোনেন ও প্রশংসা করেন। ১০ই
জুলাই বাঙ্গালী প্রতিষ্ঠিত
ইউনিয়ন অফ ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট
সমিতি এবং ১২ই জুলাই ইন্ডিয়া
সোসাইটি কবিকে সম্বর্ধনা
জানান। সেই সভার সভাপতি ছিলেন
কবি ইয়েটস। তিনি বললেন “আমার
কাব্য-জীবনে আজ
একটি মহৎ ঘটনা উপস্থিত হয়েছে
যে, আজ আমি রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুরকে সম্বর্ধনা ও সম্মান
জানাবার ভার পেয়েছি। আমার
সমসাময়িক আর কোনো ব্যাক্তির
এমন কোনো রচনার বিষয় আমি জানি
না যার সঙ্গে এই কবিতাগুলির
তুলনা হতে পারে”। এজরা পাউন্ড
কবির একজন গুণগ্রাহী হয়ে ওঠেন।
তাঁর উৎসাহে শিকাগোর POETRY
পত্রিকায় কবির কবিতা
ছাপা হয় এবং তিনি লেখেন, “রবীন্দ্রনাথের
কবিতা শুধু কবিতা নয়, সেগুলি
হ’ল তাঁর আত্ম-স্বরুপের
প্রকাশ। মানুষের সঙ্গে ঈশ্বর
ও প্রকৃতির নিবিড় অন্তরঙ্গতার
বাণী ফুটে উঠেছে তাঁর লেখায়”।
নানান পত্র পত্রিকায় প্রশংসাপূর্ণ
আলোচনা চলে কবির নামে।
১ লা
নভেম্বর ১৯১২ সালে রোদেনস্টাইনের
উদ্যোগে ইন্ডিয়া সোসাইটি
“Gitanjali, Song Offerings” প্রথম
প্রকাশ করেন। ৭৫০ কপি ছাপা
হয়। কবি রোদেনস্টাইনের নামে
বইটি উৎসর্গ করেন। এরপর ১৯১৩
সালের মার্চ মাসে ম্যাকমিলান
কোম্পানি দ্বিতীয়বার প্রকাশ
করেন। তখন ৭৫০০ কপি ছাপা হয়।
ইয়েটস ১৯১২ সালের সেপ্টেম্বর
মাসে ভূমিকা লিখে দেন। নানা
পত্র-পত্রিকায়
বইটির ভূয়সী প্রশংসা করা হয়।
গুণীজনের কাছে বইটি সমাদৃত
হয়। অবশ্য বইটি প্রকাশের আগেই
কবিতাগুলি ভাবুক সমাজের সমাদর
লাভ করেছিল।
কবি
অক্টোবরের শেষদিকে আমেরিকা
চলে যান। সেখানে থাকাকালীন
ইংল্যান্ডে “Gitanjali, Song Offerings”-
এর প্রচুর প্রশংসা
ও সমাদরের খবর পান। তাঁর মন
আনন্দে ভরে ওঠে। ১৯১৩ সালের
এপ্রিলের মাঝামাঝি লন্ডনে
ফিরে আসেন। জুন মাসে তাঁর
অর্শের অপারেশন হয়। কিছুকাল
বিশ্রামে থাকার পর ৪ ঠা সেপ্টেম্বর
জাহাজে দেশের উদ্দেশ্যে পাড়ি
দেন। মুম্বাইয়ে পৌঁছান ৪ ঠা
অক্টোবর।
দুর্গাপূজোর
ছুটির পর আশ্রম বিদ্যালয় খুলল
১৫ নভেম্বর ১৯১৩। সেদিন সন্ধ্যায়
ইংল্যান্ডের প্রকাশকের কাছ
থেকে খবর এল “Gitanjali, Song Offerings”-
এর জন্য কবি নোবেল
পুরস্কার পেতে চলেছেন।
ইংল্যান্ডের রাজকবি ১৩ই
নভেম্বর তারবার্তা পাঠান।
রোদেনস্টাইনও অভিনন্দন জানান।
এবারে বেড়ে গেলো রবীন্দ্রনাথের
শত্রু সংখ্যা। দ্রৌপদীর
স্বয়ংবর সভায় ব্রাহ্মণবেশী
অর্জুনের লক্ষ্যভেদ তাঁকে
বিজয়ী করে তোলে; বরমাল্য
প্রাপ্ত করতেই সভায় উপস্থিত
রাজন্যবর্গ ইর্শান্বিত হয়ে
যেভাবে তাঁকে অপমানিত ও অপদস্থ
করার প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন
... রবীন্দ্রনাথের
ক্ষেত্রেও তার ব্যাতিক্রম
ঘটলও না। চারিদিক থেকে ভেসে
এলো বিশ্রি মন্তব্য। কেউ বললেন
ব্রিটিশ উপনিবেশের এক কালা
আদমিকে এই পুরস্কার দেওয়া
হোল। সুইডেনের সঙ্গে তখন
ইংল্যান্ডের সৌহার্দ্য না
থাকায় ইংরেজ সম্রাজ্যবাদকে
বিব্রত করাই এর উদ্দেশ্য।
অন্যেরা বললেন সুইডেনের
রাজকুমার উইলিয়ামের সঙ্গে
রবীন্দ্রনাথের পূর্ব পরিচয়
থাকাই তাঁকে এই পুরস্কার পাইয়ে
দিল। ইংল্যান্ডের সুলেখক
টমাস হার্ডি ছিলেন রয়্যাল
সোসাইটি অফ লিটারেচারের সরকারী
প্রার্থী। নিন্দুকের দলের
ধারনা হোল, রক্ষণশীল
সুইডিশ একাডেমী হার্ডিকে
তাঁর যোগ্য মর্যাদা দিল না।
ইয়েটস এবং হেনরি জেমসও পুরষ্কার
প্রার্থী ছিলেন। তাঁরাও
ক্ষুণ্ণ হলেন। ইয়েটস ক্ষোভ
প্রকাশ করে বল্লেন, তিনি
রবীন্দ্রনাথের কবিতায় অনেক
যোগ-বিয়োগ করে
দিয়েছিলেন। “Gitanjali, Song Offerings”
- এর ভুমিকায় তিনি
যে কবিকে কত প্রশংসা করেছিলেন
তা বেমালুম ভুলে গেলেন। ভুলে
গেলেন এজরা পাউন্ড তাঁর ‘The
West Land’ কবিতার কিছু
পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন।
সেটি কিন্তু এজরা পাউন্ডের
কবিতা হয়ে যায় নি। ফরাসীরা
ভাবল আনাতোল ফ্রান্সের মত
উঁচুদরের লেখককে অবহেলা করা
হোল অগ্রাহ্য করা হোল তাঁর
দাবী। জার্মানরা রাগে অগ্নিশর্মা
হয়ে বল্লেন, ‘জাতীয়তাবাদী
লেখক রোজেগ্গারের সমপর্যায়ের
লেখক রবীন্দ্রনাথ নন’। কিছু
হতাশ, রক্ষণশীল
ও ঈর্ষাকাতর ব্যাক্তি ছাড়া
অন্যানেরা কবির পুরস্কার
লাভে খুশী হলেন। কবির গুনমুগ্ধ
এজরা পাউন্ড লিখলেন, ‘Tagore,
obviously, was unique in the known modern orient. And then the right
people suggested him. And Sweden is Sweden’।
ইউরোপে
“Gitanjali, Song Offerings”- এর
জয় জয়কার পড়ে গেলো। পরবর্তীকালে
ফরাসী, জার্মান,
পর্তুগীজ, জাপানী
প্রভৃতি নানা ভাষায় অনুদিত
হয় এই গ্রন্থ।
বিংশ
শতকের সেই সময় ভিন্ন ভিন্ন
স্থানে সৈনিকেরা যুদ্ধরত
ছিল। “Gitanjali, Song Offerings” - এর
মানবিক আবেদন তাঁদের স্পর্শ
করে, তাঁরা উদ্বুদ্ধ
হন। এই সময়ের একটি মর্মস্পর্শী
ঘটনার কথা না উল্লেখ করে থাকতে
পারছি না। ইংল্যান্ডের তরুন
কবি উইলফ্রেড ওয়েনের রণক্ষেত্রে
অকাল প্রয়াণ ঘটে। ওয়েনের মা
১৯২০ সালের ১ লা আগস্ট রবীন্দ্রনাথকে
একটি চিঠি লেখেন। যুদ্ধে যাবার
সময় ওয়েন একটি পকেট বই থেকে
“When I go from hence let this be my parting word/ That what
I have seen is unsurpassable” (‘ যাবার
দিনে এই কথাটি বলে যেন যাই /
যা চেয়েছি, যা
পেয়েছি তুলনা তার নাই’)
কবিতাটি আবৃতি করে
শোনান। ওয়েনের মা কবির কাছে
জানতে চান সম্পূর্ণ কবিতাটি
কোথায় পাওয়া যাবে। তিনি আরও
জানান যুদ্ধক্ষেত্রে
প্রাণবিসর্জনকারী সৈনিকদের
জন্য ওয়েনের গভীর মানবেদনা
এবং সহমর্মিতার কথা। ওয়েন
ছিলেন শান্তি ও সৌন্দর্যের
পূজারী। বাধ্য হয়ে যুদ্ধে
যান।
১৩ ও ১৪
নভেম্বর লন্ডন, নিউ-ইয়র্ক,
শিকাগো প্রভৃতি
শহরের প্রধান সংবাদ পত্র গুলি
কবির পঞ্চমখে প্রশংসা করেন।
কেউ লিখলেন “বাঙালী পয়গম্বর
(prophet) নোবেল পুরষ্কার
পেলেন”, কেউ বা
“প্রাচ্যের পাশ্চাত্য বিজয়
– প্রাচ্যের কণ্ঠস্বর শোনা
গেল” অথবা “প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের
সভ্যতার মিলন হোল” আবার কেউ
বা লিখলেন “একজন এশিয় প্রথম
এই পুরস্কার পেলেন – আমরা
বিশ্বজনীনতার দিকে অগ্রসর
হচ্ছি”। অন্য কাগজে লেখা হল
– “এই পুরস্কার প্রাচ্য ও
পাশ্চাত্যের উভয়ের সুখ্যাতি
অর্জন করল”।
contd...
Download and
install Avro Keyboard to view the contents.
Like our
Facebook Page- http://www.facebook.com/phoenix.punoruday
No comments:
Post a Comment