নিরন্তর
সুমনা
ভট্টাচার্য্য
বাইরে
ঘুটঘুটে অন্ধকার, শীতের
রাত। দূর থেকে ভেসে আসছে,
ঝিঁ-ঝিঁ
পোকার একঘেঁয়ে গুঞ্জন। ফুটো
ফাটা তাপ্পিমারা চাদরে শরীর
যথাসাধ্য মুড়ে, কেরোসিন
ল্যাম্পের, দপ
দপ শিখার দিকে তাকিয়ে, আবদুল
ভাবছিল নিজের জীবনের কথা।
ছোটো বেলা, ঈদের
মেলা থেকে আব্বা কিনে দিয়েছিলেন
আড় বাঁশি। বাড়ির দাওয়ায় বসে
আনমনে বাজাতো সে নানান সুর।
লেখাপড়ায় মাথা তেমন ছিল না,
তাই ঐ প্রাইমারী
স্কুল অব্দি লেখাপড়ার গন্ডি।
পাড়ায় একবার যাত্রাদলের লোকজন
এসেছিল। তাঁদের দেখে স্বপ্ন
বুনেছিল মনে, বাজাবে
ওঁদের সাথে। কিন্তু সব স্বপ্ন
কি পুরন হয়? এইসব
ভাবতে ভাবতে সে, অ্যালুমুনিয়ম-এর
কাঁসি থেকে, ভাতের
এক এক টা গ্রাস মুখে তুলছে আর
সাথে, কাঁচা লঙ্কা
আর পেঁয়াজে হাল্কা কামড়।
মুমতাজ বিবি বলল, “আর
একটু ভাত দেবো?”, আবদুল
বলে, “না”। তাদের
ছ-জনার সংসারে
আধপেটা খেয়েই দিন গুজরান হয়।
তাঁদের দুজনের সাথে আছে,
আব্বা গিয়াসুদ্দিন,
আম্মা সলমাবিবি আর
দুই মেয়ে রোশনারা ও জাহানারা।
জমি
বেচে, তিন বোন কে
একে-একে বিয়ে
দিয়েছে আবদুল। এখন সম্বল বলতে
ওই এক চিলতে জমি আর এই কুঁড়ে
ঘর। এবার বর্ষার শেষে, মহাজন
থেকে টাকা ধার করে, বাঁধাকপি
চাষ করেছে, মনে
ভাবনা যে শীতে বিক্রি করে,
দু পয়সা ঘরে আসবে।
কিন্তু এই পৌষ মাসে, বাঁধাকপির
দাম মোটেও পাওয়া যাচ্ছে না
এই পাড়াগাঁয়ে। ভাল দাম পাওয়া
যাবে শহরে গেলে, কিন্তু
সেইখানে যাওয়া খুব মুশকিল ও
খরচসাপেক্ষ।
আজ সকালে
সেলিমভাই-এর সাথে
দেখা। সেলিম মোটর সাইকেল
থামিয়ে, সানগ্লাস
খুলে, সিগারেট
ধরিয়ে বলল, “কি
ব্যাপার ভাই, মুখ
এতো শুকনো কেন?” আবদুল
বলে, “ মন মেজাজ
ভালো নেই, অনেক
স্বপ্ন চোখে নিয়ে, বাঁধাকপির
চাষ করলাম, কিন্তু
যা অবস্থা, তাতে
সপরিবারে খুদখুশি না করতে
হয়”।
সেলিম
বলল, “তুই কাল
ভোরে, বাস রাস্তায়
একশ টা বাঁধাকপি পৌঁছে দিতে
পারবি? কপি পিছু
তোকে তিন টাকা দেবো”। আবদুল
রাজি হতে গিয়ে ও থমকে যায়। তার
তো ভ্যান রিকশা নেই, কি
ভাবে যাবে বাস রাস্তায়। সেলিম
জানে এ বছর বাঁধাকপির বাজার
খুব ভালো, অকালবর্ষনে
অনেক সবজি নষ্ট হয়েছে, তাই
এই কপি বাজারে ছ টাকা পিস বিক্রি
হবে। সেলিম এই ভাবনা গুলো,
মনের একপাশে সরিয়ে
বলে, “চিন্তা করিস
না, আমার ভায়রার
খালাতুতো ভাই এই গাঁয়ে থাকে,
তুই তো চিনিস খলিল
কে, ওকে বলে দেব
ভ্যানের কথা, বিকেলে
ভ্যান টা নিয়ে আসিস’। আবদুল
রাজী হয়ে যায়। কাল সকাল ছটার
মধ্যে একশো বাঁধাকপি পৌঁছোতে
হবে বাস রাস্তায়। মোটর সাইকেলে
হুস শব্দ তুলে, সেলিম
চলে গেল।
সেইমতন
আজ খেত থেকে ফেরার পথে,
ভ্যানরিকশা নিয়ে
এসেছে আবদুল। বাড়ি ফিরে আব্বা
আম্মা, বিবি কে
বলেছে সব। একা একা ওর পক্ষে
বাঁধাকপি তোলা এবং নিয়ে যাওয়া
অসম্ভব, তাই ওদের
সাহায্যের প্রয়োজন, কাল
ভোরে। সবাই রাজি এই প্রস্তাবে।
এই
দারিদ্রে ভরা জীবনে,
মুমতাজবিবির কোনো
শখ পুরন হয়নি। এখন সে জীবনে
একটাই স্বপ্ন দেখে, মেয়েদুটো
কে লেখাপড়া শেখানোর। নিজের
জীবনের কথা ভেবে খুব আপসোস
হয়, যদি লেখাপড়া
শিখতো নিজে, তবে
গাঁয়ের মেয়েদের পড়িয়ে দু-পয়সা
রোজগার করতে পারতো।
চিন্তায়
চিন্তায় কারুর ই ঘুম হল না
সারারাত। রাত জাগা পাখি আর
কুকুরের ঘেউ ঘেউ ডাকে, পৌষের
শিশিরঝরা রাত, আধো-জাগরণে
কেটে গেল। ভোররাতে উঠে আবদুল,
সবাই কে নিয়ে কর্মযজ্ঞে
নেমে পড়ল। প্রথমে ঠান্ডার
তীব্র কামড়, কষ্ট
বেজায়, আস্তে
আস্তে শরীর গরম হয়ে গেল। চার
ট্রিপে, একশ কপি
বাস রাস্তায় জমা হল যখন,
তখন সাড়ে পাঁচটা।
এবার অপেক্ষা শুধু সেলিমের।
পেটে ভোর রাত থেকে দানাপানি
নেই, পৌষ মাসের
কনকনে ঠান্ডা হাওয়া আর কুয়াশা।
বাস গুলো
রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে হেডলাইট
জ্বালিয়ে, বিপদ
এড়াতে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর,
দশটা নাগাদ সেলিম
এলো গাড়ি নিয়ে। দেরির, কোনো
কারন না দেখিয়ে, সে
বলল, “তুলে এনেছিস
তো একশো পিস বাঁধাকপি?”
আবদুল বলল, “হ্যাঁ"।
তারপর বাঁধাকপিগুলো কে গাড়িতে
তুলে দিল, চার
জনে। আবদুল যখন সেলিমের কাছে
টাকা চাইল, তখন
সে বলল, “এখন পঞ্চাশ
টাকা রাখ, পরে
বাকি দেবো। কাল ভোরে আরো পঞ্চাশ
টা কপি দিতে পারবি তো?”
আবদুলের
তো রাজী না হয়ে উপায় নেই,
সে আবার রাজী হয়ে
যায়। এইভাবেই নাগপাশে জড়াতে
থাকে অনবরত।পাশের চায়ের
দোকানে, এফ এম
রেডিও তে হঠাৎ গানের কলি কানে
আসে আবদুলের, “এ
খেলা চলছে নিরন্তর, এ
খেলা চলবে নিরন্তর............”।
Download and
install Avro Keyboard to view the contents.
Like our
Facebook Page- http://www.facebook.com/phoenix.punoruday
No comments:
Post a Comment