।। ছোট্ট আশীর্বাদ... The Little Blezz ।।
~ পৌষালী
পাল ~
সেবার ছুটিতে...
ব্লেজ একটি সাধারন মেয়ে। আমার প্রিয় বান্ধবী।
ওর একটা অদ্ভুত ব্যাপার ছিল। ও শুধু একটাই স্বপ্ন দেখত। সেই স্বপ্নটা একটা গল্পের
মতো। ওর পরিবারকে ও কিছু জানায়নি কোনদিন সেই ব্যাপারে। কেন জানি
ওর একটা বিতৃষ্ণা ছিল সমাজের ওপরও। ওর মা আন্টিরুথ এটা আন্দাজ করেছিলেন যে ও কোনো একটা অবসাদে ভুগছে। কিন্তু মেয়ের কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে
তিনি মুষড়ে পড়েছিলেন। আমিও কিছু জানতে পারিনি প্রথমে। সেবার ছুটিতে ওদের নরথাম্বেরল্যান্ড
এর বাড়িতে উঠেছিলাম অন্যবারের মতো। কিন্তু ব্লেজ দেখি
একটু বেশি ই চুপচাপ। রাতের খাবার পৌঁছে দেবার সময় দেখি আন্টি আমায় ইশারায় ডাকলেন। ব্লেজ শুয়ে পড়ার পর আমি ওনার কাছে যাই। আন্টি
খুব শক্ত মনের মানুষ ছিলেন কিন্তু এই প্রথম দেখি উনি খুব ভেঙ্গে পড়েছেন। আমায় সব
বলে বলেন ওর থেকে কিছু জানা যায় কিনা। আসলে আমি যেহেতু প্যারাসাইকলজি নিয়ে পড়ছি, তাই
উনি দেখলাম আমাকেই এই ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে বললেন। সেদিন রাতে শুয়ে আছি ব্লেজ এর
পাশে একটা বই নিয়ে, শুনি ব্লেজ ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করছে। অনেক চেষ্টা করেও বুঝতে
পারলাম না কিচ্ছু। পরদিন সকালে উঠেই ওকে ধরলাম, বল তোর কি হয়েছে, এত চুপচাপ আছিস
কেন? দেখি ও গম্ভীর হয়ে গেল আরও। কিন্তু তারপরই বলল, তোকে আমি কিছু বলতে চাই, শুধু
কথা দে যে তুই আর কাউকে কিছু বলতে পারবি না। অগত্যা। রাজি হয়ে গেলাম। একটু আগে
বৃষ্টি হয়ে গেছিল, কিন্তু আকাশে হালকা মেঘ। তার মধ্যে আমরা সামনের উপত্যকাটায়
হাঁটতে হাঁটতে গল্প করছিলাম। আমি জানতাম ও একটা স্বপ্ন দেখতো কাটাকাটা ভাবে। কোন একটা দুর্গ, একটা জঙ্গলের মধ্যে কেউ বা কারা ছুটছে, আর
একটা শিশুর কান্না; কখনও দেখতো ঘোড়া ছুটে চলেছে, একটা আস্তাবলে অনেক ঘোড়ার মধ্যে কিছু
ছায়া...কিন্তু ঘুম থেকে ওঠার পড়ই ওর খুব কান্না পেতো। আর গত কয়েক মাসে
এটা নাকি অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গেছে। এই কয়েক মাস ও আরও কিছু দেখতে পায়, আর সেটা আরও স্পষ্ট করে। ওর করুন অবস্থা দেখে ঠিক
করলাম, ওকে আমার সাথে ইউনিভার্সিটিতে নিয়ে যাব। আমার প্রফেসর মিঃ নাশৎ এর কাছে।
অ্যান্টির কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে রেখেছিলাম আগেই, কিন্তু বলিনি আসল কারণটা। এরপর আমি ওদের বাড়িতে আরও দিন পাঁচেক ছিলাম।
ফেরার
পরে...
আমি আগে থেকেই নাশৎ এর কাছে আপয়েনমেনট নিয়ে
নিয়েছিলাম, তাই সময়মতো আমরা ওনার সাথে দেখা করতে যাই। প্রসঙ্গত, নাশৎ ভীষণ অমায়িক মানুষ, আর ওনার
অভিজ্ঞতাও বিশাল আর আমায় খুব স্নেহ করেন। তাই আমার আশা ছিল, উনি আমার বন্ধুকে
যথেষ্ট সময় নিয়ে দেখবেন। ব্লেজও আমায় খুব ভরসা করে, তাই আমার এক কথায় মেয়েটা রাজী
হয়ে যায়। এবার সবকিছু নাশৎ এর ওপর নির্ভর করছিলো। বলা যায়, ওনার
জন্যই আমি আমার বন্ধুকে আগের অবস্থায় ফিরে পেয়েছিলাম। একটা কলঙ্কজনক ইতিহাসের
কবরের ওপর বর্তমানের ভিত স্থাপন করতে পেরেছিলাম। উনি প্রায় একমাস ধরে ব্লেজ এর ওপর
স্টাডি করেন আর একটু একটু করে ওর স্বপ্নের ছবিতে রং দিতে থাকেন। আর এটা আমার
সৌভাগ্য যে ওনার পদ্ধতি আমি খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। তবে আজ আমি তোমাদের
সেই পদ্ধতিটা বলতে আসিনি, আমি তোমাদের কাছে
আমার বন্ধুর তরফ থেকে সেই যুগের একটা বেদনাদায়ক কাহিনী তুলে ধরব। একটা
জন্মান্তরের কাহিনী।
ইউরোপ এ তখন
মধ্যযুগ চলছে। জায়গার নামটা ব্লেজ বলতে পারে নি। কিন্তু নাশৎ এর বিশ্লেষণ অনুযায়ী
হয়ত সেটা আয়ারল্যান্ড এর আশেপাশে কোথাও হবে। তবে সময়টা যখনকার তখনও বিদ্রোহের আগুন
জ্বলে ওঠেনি ঘরে ঘরে। জমিদারি প্রথা বেশ রমরমিয়ে চলছে। আর সমাজের এই উঁচু শ্রেণীর
মানুষগুলো তাদের প্রভাব খাটিয়ে চলেছে। ব্লেজ এর বাবা স্যার রওলান্দ ছিলেন একজন
ব্যারন, তখনকার দিনের এক সম্ভ্রান্ত মানুষ। পুরুষানুক্রমে ওরা তাই ছিলো। মা ইসাবেল ছিলেন একজন সুন্দরী সম্ভ্রান্ত রাশভারীমহিলা। ব্লেজ ছিল
তাঁদের একমাত্র সন্তান, আর বাবার চোখের মনি—এলিনর।
আমি এলিনর, বাবার আদরের
এলিন। আমার বাবা খুব মানী লোক ছিলেন। সবাই খুব শ্রদ্ধা করতো বাবাকে, তার মধ্যে
কতটা অন্তরের আর কতটা লোকদেখানো আমার জানা ছিল না। সোনার চামচ মুখে নিয়ে
জন্মেছিলাম। বাবার ঘরের দেওয়ালে কোন শিল্পীর হাতে আঁকা মায়ের একটা ছবি ছিল, তাতে
মায়ের মুখটা দেখেছিলাম। এছাড়া মার কথা মনে পড়েনা আমার। শুনেছিলাম তিনি নাকি
অত্যন্ত সুন্দরী ছিলেন। সেই সময়ের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের মহিলা। আমাদের বাড়িটাতো
শুধু বাড়ি ছিল না, তাকে একটা ছোটখাটো দুর্গ বলা যায়। আমার সমস্ত রকম দেখাশোনার
দায়িত্ব ছিল মাবেল এর ওপর। আমার দাই। তবে সে প্রায় আমার মায়ের জায়গাটাই নিয়ে
নিয়েছিলো, আদর আর
শাসন দুটোই করতো সে। কিন্তু যত বড় হচ্ছিলাম, দেখেছি মাবেল আমায় আর শাসন করতো না,
বরং নিজের জায়গাটা বুঝে নিয়েছিল। কেন জানি, সে ক্রমশ মনে রাখতে শুরু করে যে আমি
তার মালকিন। আমার হাজার আপত্তিও সে তখন শুনত না। তবে সেই আমায় সমাজে আমার স্থান,
আমার বাবার পদমর্যাদা, আমাদের পরিবারের মানসম্মান নিয়ে শিক্ষা দিতো। বাবা খুব ব্যাস্ত
থাকতেন সব সময়, আমি বাবাকে প্রায় পেতামই না,
তাই যখন পেতাম... কিছুতেই ছাড়তে চাইতাম না। আমাদের কাসেল টা সবসময় চাকরবাকরে গমগম
করতো। কিন্তু আমার জন্য নির্দিষ্ট ঘরটা ছিল কাসেল এর উপরের দিকে, তাই আমি একা একা
আমার জগত তৈরি করে নিয়েছিলাম।
আমি যখন খুব ছোটো, তখন আমার বাবা দেশের রাজার
আমন্ত্রণে যুদ্ধে গিয়েছিলেন। ফিরে আসেন বেশ কয়েক বছর পর। তখন আমি ছয়। আমাদের সমাজে
নাইটদের খুব সম্মান ছিল। এঁরা সম্মানিত হতেন যুদ্ধ করার জন্যই, কিন্তু একদিন নাইট হবার স্বপ্ন নিয়ে যারা আসতো—তারা
ছিল স্কোয়ার। এই স্কোয়াররা ছিল নিচু তলার বা দরিদ্র শ্রেণীর মানুষ। ইতিহাস তাদের
কথা বলেনা। এরা কোন নাইট বা আমাদের মত ব্যারনদের নীচে কাজ করতো, সময় সময়ে মনিবদের
সাথে যুদ্ধে যেতো, যুদ্ধের কৌশল শিখতো, যুদ্ধক্ষেত্রে ভাল প্রদর্শন করলে একসময় হয়ত নাইটও হত
স্তরে স্তরে। কেউ যুদ্ধে মারা যেত আর কেউ কেউ সারাজীবন হয়ত মনিবের কর্মচারী হয়েই
কাটিয়ে দিত। শুনেছি বাবার কাছে, এই জমিদারিতে থাকাকালীন রাজার হয়ে যুদ্ধেও যেতে হতো তাদের, এককথায়
এদের কোনও নিজস্ব জীবন ছিলোনা। বাবা সেবার ফেরার সময় আরও কিছু স্কোয়ার নিয়ে ফিরেছিলেন। সাধারনত এরা
সাত-আট বছর থেকে প্রায় কুড়ি বছর বয়স পর্যন্ত থাকতো। এদের মধ্যে একটা ছেলে ছিলো, যাকে সবাই লেনি বলে ডাকতো। কাসেলএর অন্যান্য কাজের লোকদের মধ্যে সেও বহাল হয়েছিল, কিন্তু যেহেতু তার বয়স কম ছিল, তাই তাকে দেওয়া হয়েছিল একটু হালকা কাজ, আমার ফাই-ফরমাশ খাটা। আমাকে সবাই ভীষণ ভালবাসত, কিন্তু আমার আবদার মেটানোর মতো সময় কারোর ছিলনা, এমনকি মাবেলও ছেলেভুলানো ছড়া কাটতেই বেশি পছন্দ করতো আমার সাথে না খেলে। এই অভাবটা আমার পূরণকরার জন্য লেনিকে বহাল করা হয়, আর লেনি আমার সব শূন্যস্থান ভরিয়ে দেয় একাই।
আমার জন্য লেনি ছোটছোট মাটির, পাথরের বা কাঠের পুতুল নিয়ে আসত। ওর আমার সাথে খেলার অধিকার ছিলনা, তাই ওগুলো আমার হাতে তুলে দিয়েই চলে যেতো। আমি যাতে একঘেয়েমিতে না ভুগি, তার জন্য প্রায় প্রতিদিন নিত্য নতুন জিনিস এনে দিতো, কোথা থেকে যোগাড় করতো কে জানে? কিন্তু আমার চাওয়ার আগেই ওগুলো আমার হাতে চলে আসতো ঠিক। বড়দের কাছে ওগুলো ছিলো মূল্যহীন, তবু আমার কাছে সেগুলো আকাশ প্রমাণ মুল্যবান ছিল। আমাদের মতো অন্যান্য সম্ভ্রান্ত ঘরের ছেলেমেয়েরাও আমার সাথে খেলতে আসতো, বা আমিও যেতাম। সবসময় আমাদের খেলার দলটার বাইরে লেনি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতো জিনিসপত্র যোগান দেওয়ার জন্য, কক্ষনো খেলতে ডাকতো না কেউ, আমাকেও ডাকতে দিতোনা। দলের ছোট বড় ছেলেরা কোনো ভুল ত্রুটির জন্য ওকে মারতও, কিন্তু তাও ও চুপ করে থাকতো, শুধু সবসময় আমার পাশে ছায়ার মতো লেগে থাকতো যাতে আমার কোনওভাবে না আঘাত লেগে যায়। সেই বয়সে আমার বোঝার মতো মন বা বুদ্ধি কোনওটাই ছিলোনা, ভেবে নিয়েছিলাম এটা ওর কর্তব্য, আর ওর ওপর হুকুম করা আমার কর্তব্য। আরও পাঁচ ছয় বছর এভাবেই চলেছিলো। সবাই সবারমতো নিজের নিজের দায়িত্ব পালন করেছে। কিন্তু ঘটনাটা ঘটলো তারপর। সেদিন দুপুরবেলায় আমরা খেলছিলাম। লেনি আমায় কাঠের খুব সুন্দর ছোট্ট একটা ঘোড়া তৈরি করে এনে দিয়েছে। বন্ধুদেরকে ওটা দেখিয়েছি। তারপর আমি মনে হয় কোনও কারনে ওই জায়গা ছেড়ে একটু উঠেছিলাম, হঠাৎ খুব চিৎকার চেঁচামেচি শুনে দৌড়ে এসে দেখি এডওয়ার্ড মাটিতে পড়ে আছে, লেনি তার ওপর বসে ওর জামা ধরে টানাটানি করছে, আর আরও দুজন লেনিকে সরানোর চেষ্টা করছে, সেই সাথে লেনিকেও খুব মারছে। পাশে অন্য মেয়েরা জটলা করে চেঁচাচ্ছে। আমাকে দেখে লেনি এডওয়ার্ডকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়, কিন্তু তখনি এডওয়ার্ড উঠে বাকি ছেলেদের সাথে ওকে মারতে শুরু করে। আমি হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম, আমার মাথায় কিচ্ছু ঢুকছিলো না। ঠিক সেই মুহূর্তে আমায় লেনি প্রথমবার এলিন বলে ডেকে ওঠে…
ওর ডাক আমার সম্বিত ফিরিয়ে আনে, আমি দৌড়ে ওদের মধ্যে ঢুকে ব্যার্থ চেষ্টা করতে থাকি লেনিকে বাঁচানোর, কিন্তু অতগুলো ছেলের সাথে আমি পারবো কেন? এদিকে আমার এই ব্যাবহারে ওরা খুব অবাক হয়ে যায়, আর লেনিকে ছেড়ে আস্তে আস্তে সরে পড়ে। গায়ের ধুলো ঝেড়ে লেনি উঠে দাঁড়ায় আর আমার কাছে ক্ষমা চায় আমার নাম ধরে
ডাকার জন্য। লেনির মুখ আর কপাল ফেটে রক্ত পড়ছিলো, তাই আমি নিজেই গিয়ে আমার বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে থাকা খেলনাগুলো তুলছিলাম। হঠাৎ চোখে পড়ে আমার নতুন ঘোড়াটা নেই। সেই মুহূর্তে আমি কিচ্ছু বলিনি, কিন্তু ফেরার পথে জিজ্ঞেস করি ওকে, ও ওর জামার মধ্যে থেকে বের করে আনে সেটা…ভাঙা। আমার ভীষণ রাগ হয়ে গেলো, মাথাতেই এলনা যে ওটা কে ভাঙতে পারে, আমি লেনির চুলের মুঠি ধরে খুব লম্ফঝম্ফ করে বললাম, এডওয়ার্ডরাই ঠিক করেছে তোমায় মেরে, তোমায় আমার আরও শাস্তি দেওয়া উচিত। ওমা! লেনি আমায় অবাক করে দিয়ে রাস্তার ওপরেই হাঁটু মুড়ে বসে পড়লো। ওর ছোট্ট ছুরিটা বের করে আমার হাতে দিয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকে। আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছিলো। শেষে লেনিই আমায় বাঁচিয়েদিলো। বললো, ঘোড়াটা ভাঙার কথাও। এডওয়ার্ড আমি চলে যাওয়ার পরই লেনিকে ডেকে আদেশ করে আরএকটা ওরজন্যও বানিয়ে দিতে। কিন্তু লেনিতো আমার কাজে নিযুক্ত হয়েছে, তাই অন্য বাইরের ছেলের কাজ করবে কেন? সেটা বলতে ওরা বলে তাহলে এলিনরএর ঘোড়াটাই ওরা নিয়ে নেবে। লেনি বাধা দিলে, এডওয়ার্ড সেটা ভেঙে দেয়। লেনির মাথায় রক্ত চড়ে যায়, সে ঘোড়াটা ছিনিয়ে নিতে গেলে এডওয়ার্ড ওকে মারতে থাকে, উল্টে লেনিও ওকে মারে। আমার খুব মায়া হচ্ছিলো ওর জন্য। আমি ছুরিটা ওর হাতে তুলে দিয়েছিলাম, বলেছিলাম, আমার ভালবাসাকে সারাজীবন ধরে এইভাবে রক্ষা করার জন্য। ছুরিটা নিয়ে ওর বড়বড় চোখ তুলে আমার দিকে তাকিয়েছিলো লেনি। বলেছিলো, তোমায় আমি নাম ধরতে পারবনা, কিন্তু তোমায় কি আমি ছোট্ট আশীর্বাদ বলে ডাকতে পারি? লিটল ব্লেজ। হ্যাঁ, ও আমায় ওর দেওয়া নামটা ধরেই ডেকেছিলো সারাজীবন।
ঝড়টা উঠবেই জানতাম। আজ নাহলে কাল। লেনিও
ভেবেছিল শুধু চামড়ার ওপর দিয়েই যাবে। কিন্তু আমাদের বুঝতে একটু দেরি হয়েছিলো বা সময় এর
হিসেবটা আমরা একটু দেরি করে শুরু করেছিলাম। আমরা ফিরে কাউকে কিছু জানাইনি, কিন্তু
রাতের আগেই খবরটা হাওয়ায় ভেসে কাসেলএ চলে এসেছিলো আর আমার কাছে এসেছিলো আরও পরে। অবাক হয়েছিলাম রাতের মধ্যে আর লেনির দেখা পাইনি বলে। মনটা
সেই প্রথমবার ওর জন্য, একটা স্কোয়ার এর জন্য
ব্যাকুল হয়েছিলো। আশা করেছিলাম, খবরটা ইনিয়ে বিনিয়ে বাবার কানে যাওয়ার পর হাজার হোক, আমার মতামতটা নিশ্চয়ই বাবা জানতে
চাইবেন, কিন্তু... কেউ কিচ্ছু জানতে চায়নি আমার কাছে। পরের দিনও লেনি এলনা, দরজার
উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য কাউকে দেখলাম না। মাবেলকে বারবার জিজ্ঞেস করেও কোনও উত্তর পাওয়া
গেলোনা। বিকেলের
দিকে দেখি আমারই বয়সী একটা মেয়েকে নিয়ে মাবেল এলো আমার কাছে। বিয়াত্রিচে। এই নাকি
এবার থেকে আমার খেলার সাথী, আমার হুকুম তামিল করার লোক। কিন্তু কেন জানি মাবেল কে
গম্ভীর লাগল, কেন জানি আমিও ওকে আর ঘাঁটালাম না। সেদিন রাতের খাবারের পর অনেকক্ষণ
দাঁড়িয়ে ছিলাম আমার ঘরের জানলায়, মন বলছিলো, অন্য কিছু হতে চলেছে। অন্য কিছু হয়েছিলো, অবশ্যই হয়েছিলো, সবাই জানত,
শুধু আমি জানতাম না, কেউ মনে করেনি এটা আমার জানার কোন বিষয়। আমি জেনেছিলাম আরও
একদিন পড়ে। লেনি যেহেতু আমার খিদমদগার ছিল তাই ও থাকত বৃদ্ধ সামুয়েল এর কাছে।
স্যামুয়েল এর ওপর ছিল আস্তাবলের ভার, আমাদের অনেক পুরনো চাকর, ওর নিজস্ব একটা ছোট
ঘর ছিলো, সেখানেই
স্যামুয়েল লেনিকে নিয়ে থাকতো, লেনিকে অন্য চাকরদের সাথে থাকতে হতো না। আমি পরদিন
সকালে সকলের নজর এড়িয়ে স্যামুয়েলের ঘরে যাই। সে কিছু একটা কাজ করছিলো, আমায় দেখে উঠে
দাঁড়ায় আর আস্তে আস্তে হেঁটে ঘরের এক কোনায় গিয়ে কিছু একটা নিয়ে আমার হাতে এনে
দেয়, দেখি সেটা একটা কাঠের ঘোড়া, একদম পুরনোটার মতো। বাকরুদ্ধ আমায় কিছু
ভাবার সময় না দিয়ে নিজেই জানিয়েছিলো, লেনিকে অন্য ব্যারনের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, তিনি আমার কাকা। আমাদের সময় এই স্কোয়ার বা নকর-চাকররা তো সম্পত্তি ছিলো, আমরা এদের নিয়ে দর কষাকষি করতে পারতাম, যখন তখন বিক্রি বা কিনতে পারা যেতো, দান করা যেতো। লেনি সারা রাত জেগে আমার জন্য
ঘোড়াটা তৈরি করেছিলো কিন্তু আমার সাথে দেখা করার অধিকার পায়নি, তাই বাধ্য হয়ে ওটা স্যামুয়েল এর
কাছে রেখে গেছে। পায়ে পায়ে ফিরে আসি নিজের ঘরটাতে। আমি একটা অন্য জিনিস ভাবছিলাম,
লেনি নাহয় আমার জন্য ঘোড়াটা বানিয়ে রেখে গেছে, কিন্তু ও কি জানত যে আমি ওর খোঁজ
করব? খোঁজ করতে করতে ওর ঘরে হানা দেবো? ওর শরীরের গন্ধটা বুক ভরে নিতে নিতে অপেক্ষা করবো?
কিন্তু আমি অপেক্ষা করিনি, আমি ইতিমধ্যে আরও
বেশ কিছু বছর অতিক্রম করেছি, এখন আমি ষোলো। আমি বাবার পর
ব্যারনেট হওয়ার জন্য নিজেকে তৈরি করছি, যে
ছেলেগুলোর সাথে একদিন আমার ঝগড়া বেধেছিলো, আজ ওরাই আমাদের পরিবারের বন্ধু। আমি আমার যাবতীয় কাজে সঙ্গী করেছি
বিয়াত্রিচেকে, মাবেল এখনও অবসর নেয়নি আর এডওয়ার্ড আজ আমার প্রিয়তম বন্ধু। আমার
ঘরের যাবতীয় আসবাবপত্রের সামান্য হলেও পরিবর্তন হয়েছে। শুধু দুটো জিনিস বদলায়নি;
এক, আমার ঘরের জানলাটায় সময় কাটানো আর লেনির দেওয়া সেই ঘোড়াটা। এডওয়ার্ড বা অন্যরা
আমার ঘরে আসে, কুশল বিনিময় করে, নিজেদের কথা বলে, প্রয়োজনীয়- অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা
চলে, চলে রাজনৈতিক আলোচনাও। আমাদের জমিদারীতে কি হচ্ছে না হচ্ছে, সেসব কথাও হয়।
বিয়াত্রিচেই একমাত্র আমার ঘরে অনুমতি না নিয়েও ঢুকতে পারে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, ওই ঘটনার পরে
আমার ঘরে ঘোড়াটা দেখলেও এডওয়ার্ড কিছু বলেনি কখনো। আমিও কোনোদিন এই নিয়ে কারোর
সাথে আলোচনা করিনি, এমনকি বিয়াত্রিচেকেও লেনির ব্যাপার নিয়ে কোনোদিন কিছু বলিনি।
কিন্তু এত উপেক্ষা সত্ত্বেও একদিন আবার সব বদলে গেল, আবার একটা ঝড় উঠলো, আর তা উঠলো সবার অজান্তে
সবার অলক্ষ্যে কিন্তু যখন উঠলো...
বাবা আমার আর এডওয়ার্ডএর মেলামেশা খুব ভাল
মনেই নিয়েছিলেন। এডওয়ার্ডএর সাথে আমার বিয়ে হলে সেটা আমাদের আর এডওয়ার্ডদের
জমিদারী, দুপক্ষের ক্ষেত্রেই লাভজনক। আমিও এতে আপত্তিকর কিছু দেখিনি, আর
এডওয়ার্ডএর কথা তো ছেড়েই দিলাম, ও যেন এই ঘটনাটার জন্যই অপেক্ষায় ছিলো। বিয়াত্রিচেও দেখলাম খুব খুশি, বারেবারে কোথা
থেকে ঘুরে আসে আর আমার কাছে বিয়ে নিয়ে আলোচনা করে। তবু কোথাও একটা তাল কেটে যাচ্ছিল
বারবার। আমার এত আলোচনা ভালো লাগছিলো না সবসময়। আমি হয়ত অন্য কিছু খুঁজছিলাম, শুধু বাবার মুখ
চেয়ে কাউকে কিছু বলিনি বা বলতে বাধাও দিইনি। কিন্তু সেটাই হলো, আর আমার ক্ষমতায় ছিলোনা যে আমি
নিজেকে আটকে রাখবো। একটা ঢেউ উঠলো, আমায় ভাসিয়ে নিয়ে গেলো, আর আমার ভবিষ্যৎটা সবার
অলক্ষ্যে লেখা হয়ে গেলো।
দিনটা ছিল মেঘলা। আজকের দিনের জন্য কাসেলটা
যেন আরও সুন্দর হয়ে গেছিলো। এক মাস ধরে তিলেতিলে সাজানো হচ্ছিল। কারন আজ আমার আর এডওয়ার্ড এর
বিয়ের কথা ঘোষণা করার কথা। দূর দূরান্ত থেকে আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু-বান্ধবে আমাদের
দুর্গটা গমগম করছিলো। সেই উপলক্ষ্যে শুনলাম একসময় বিয়াত্রিচের কাছে, যে বাবা যেসব চাকরদের একদা বিক্রি করে দিয়েছিলেন,
তাদের আবার কিনে নিচ্ছেন, সেই সাথে বন্দীদের অনেককে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে। আর তা
শুনেই হঠাৎ আমি চমকে উঠেছিলাম। তাহলে কি...? সারাটা দিন আমি জানলার পাশে
দাঁড়িয়েছিলাম। আমার মনটা অদ্ভুত রকমের ভারী হয়েছিলো। আর বারবার চোখ চলে
যাচ্ছিল সেই কাঠের ঘোড়াটার দিকে। কেন জানি মনে হচ্ছিল,
লেনি এসেছে আমার দরজার ঠিক পিছনে, হুকুম তামিল করার জন্য। শুধু আমার ডাকার
অপেক্ষা। হ্যাঁ এসেছিলো সে, তাকেও অন্যদের সাথে কিনে নেওয়া হয়, কিন্তু সে একবারও আমার সাথে দেখা
করেনি। এতদিন ধরে তৈরি করা উপেক্ষার বাঁধটা একনিমেষে চুরমার হয়ে যায়। আমি আহত
হয়েছিলাম। লেনি নিজে থেকে একবারও তার ছোট্ট আশীর্বাদ এর কাছে আসেনি। বিয়াত্রিচে
খুব যত্ন নিয়ে আমায় সাজিয়েছিলো। সবাই একে একে
দুর্গের বিশাল উঠোনে জমায়েত হয়েছিল। এডওয়ার্ড তার পরিবারের সাথে দাঁড়িয়েছিলো। চাকরেরা উপাদেয়
খাদ্য আর পানীয় বিতরন করছিলো। আর সবার সামনে পূর্বপরিকল্পিত ভাবে আমি সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসেছিলাম সেদিনের আসরের মধ্যমনি হয়ে। সেই সময়
সবাই অবাক হয়ে দেখছিলো আমায়, চোখ পড়েছিলো এডওয়ার্ড এর দিকে, কিন্তু অদ্ভুত লেগেছিলো আমার ওকে দেখে, ওর চোখে অজস্র
লোভ দেখতে পেয়েছিলাম আমি। বাবার কাছে এসে দাঁড়িয়েছিলাম আমি। আর কিছুক্ষনের মধ্যে আমাদের বিয়ের কথা ঘোষণা করে
দিলেন উনি। ঠিক সেই মুহূর্তে আমার চোখ পড়ল একদম অন্ধকার কোনাটার দিকে...
ওদিক থেকে এগিয়ে আসছে বিয়াত্রিচে আর ঠিক তার
পিছনে পিছনে মদ পরিবেশনের থালা হাতে আমাদের পুরনো স্কোয়ার লিওনার্দ---আমার লেনি।
আমি চমকে উঠলাম বললে ভুল হবে, আমি কিছুক্ষন স্তব্ধ হয়েছিলাম, হয়ত বা ওই সময়টায় আমি
শ্বাসপ্রশ্বাসটাও নিতে ভুলে গেছিলাম। লেনির চোখ আগের মতই শান্ত। আমার আর কিচ্ছু
মনে পড়ছে না, কারন বাকি সময়টুকু আমার চোখ শুধু লেনিকেই দেখে গেছে। কখন নাচের আসর
বসলো, কখন আমরা খেতে গেলাম, আর কিছুই চোখে পড়লো না। আমি বোধহয় সারাক্ষন ওর দিকেই
তাকিয়েছিলাম। আর লেনি? হ্যাঁ, সেও দেখছিল বৈকি। সারাক্ষন তো আমার দিকেই তাকাচ্ছিলো। কাজের ফাঁকে ফাঁকে, আসতে যেতে।
কিন্তু একবারও কাছে আসেনি। যতটা সম্ভব সবার নজর বাঁচিয়ে দূরে দূরে থেকেছে। এত
সুন্দর হয়ে গেছে ও? যেকোনো রাজপুত্রকেও হার মানায়। লম্বাচওড়া বিশাল কিছু নয়, সুঠাম
সাবলীল কুড়ি-একুশ বছরের দীপ্ত যুবক। রাতে ঘুমেও যে কখন হানা দিয়েছিলো ও, বুঝতে
পারিনি। বুঝলাম ঘুম ভাঙার পর। ঠিক যে জায়গাটা ফাঁকা লাগছিলো, বেমানান লাগছিলো, সে জায়গাটা
ভরাট হয়ে গেছে। সব থাকার মাঝেও না থাকার কারণটা পরিষ্কার হয়ে গেছে। এতদিনের
উপেক্ষা আসলে নিজের কাছে নিজেকে লুকিয়ে রাখা ছাড়া আর কিছুই ছিলনা। আমি, এলিনর আসলে
লেনির জন্যই অপেক্ষা করেছিলাম। ছোট্ট বেলার খেলার ছলে ওকে ছুঁয়ে যাওয়া এই
ভালবাসারই বীজ ছিল। কিন্তু শুধু কি একা আমিই ভালবেসেছিলাম? লেনি বাসেনি? লেনি কি
এত দিনে আমায় একবারও মনে করেছে? শুধু মনে করা নয়; আমি, এক ভবিষ্যৎ ব্যারনেট যেভাবে
পাগল হয়ে গেলাম একটা স্কোয়ার এর জন্য, ও কি আদৌ সেটা বুঝতে পেরেছে? এর উত্তর আমি
পেয়েছিলাম, এক দিন পর।
সেদিন বৃষ্টি নেমেছিলো। আগের দিনের মতো সবাই আনন্দে মেতে ছিল। আমিও আগের দিনের মতোই লেনিকে দেখে
যাচ্ছিলাম, সবার চোখ এড়িয়ে। কিন্তু বৃষ্টি নামায় লেনি চলে যায়। যারা ঘোড়ায় করে
উৎসবে যোগ দিতে এসেছিলেন, তাদের ঘোড়াগুলোকে আস্তাবলে তুলে দিতে। ঠিক এই সময় সবার
নজর থেকে পালিয়ে আসি আমি। পালিয়ে আসি লেনিকে দেখতে আসার জন্য। ওকে খুঁজে পেলাম, একদম ভিজে, গায়ের কাপড় গায়েই আটকে গিয়ে ওর শরীরের প্রত্যেকটা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে প্রকট করে তুলেছে। সুন্দর
সুঠাম পাতলা চেহারার লেনি অন্যদের থেকে একটু আলাদাই ছিলো দেখতে। যুদ্ধবাজদের মত কঠিন কঠোর
ছিল না ও। ওর মধ্যে একটা আলাদা কমনীয়তা ছিল, আবার অন্যদিকে খুব ভালো তলোয়ার
চালাতেও শিখেছিলো। কিন্তু কি হলো সেদিন আমার? ওকে আমার ভালোলাগত কিন্তু ওই নজরে আমি কোনদিনও দেখিনি। একজন চেনা ছেলের
পুরুষ হয়ে ওঠা, আর প্রথমবার সেটা কোনো মেয়ের নজরে আসা, যে কিনা নিজেও প্রথমবার আয়নায় নিজেকে
দেখে নতুন রূপে। কই? এডওয়ার্ডকে দেখে তো এমন কথা মনেও আসে না, সে তো শেষ কয়েক বছরে
আমার সবচেয়ে কাছের পুরুষসঙ্গী। অন্যদিকে লেনি আমার ছোটবেলার সাথী, যদিও সে
বেশীরভাগ সময় আমার আবদার মেটাতেই ব্যাস্ত থাকতো, তারপর তো সে চলেই গেছিলো, আসার কথাও কি
ছিল? তাহলে আজ লেনিকে সিক্ত দেখে আমার এমন হল কেন? মনের কোনো গোপন কোনে কখন যে নিজের অজান্তেই
বদলে গেছিলাম আমি কে জানে? জানিনা লেনিও আমায় সেই অবস্থায় দেখে কি ভেবেছিলো? আমার বড় হয়ে
ওঠাটা যে ওর কাছেও অজানা ছিল। অবাক সে নিশ্চয়ই হয়েছিলো, কিন্তু তার চেয়েও বেশি ভয়
পেয়েছিলো, তবে সে ভয় আমার জন্যই। আমাকে উপলক্ষ করে অনুষ্ঠান, আর আমিই অনুপস্থিত,
এটা অবশ্যই কেউ ভালো মনে নেবে না। কিন্তু কোনোকিছু শোনার মত অবস্থায় আমি কি আদৌ
ছিলাম? আমি পূর্বনির্ধারিত চিরাচরিত সমাজ ও লৌকিকতা থেকে সরে এলাম, এক মুহূর্তে
ভুলে গেছিলাম আমি কে, আমার অবস্থান কি। কোন সুদূরপ্রসারী ফল ভাবতেই পারিনি, যেটুকু
সামনে পেয়েছিলাম, তাকে শুধু নিংড়ে নিতে চেয়েছিলাম; মনে হয়েছিল, বাকি যা কিছু সামলে
নেবে লেনি, প্রতিবারের মতো।
না, আমি কিছু ভুল করিনি, আমি আমার কোন
কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত নই। আমি লজ্জা পাইনা আমার ভালবাসার বহিঃপ্রকাশে, আমার ভয়
লাগে না ওর দিকে এগিয়ে যেতে, ওকে কাছে টেনে নিতে, বা নিজেকে ওর চওড়া কাঁধে মিশিয়ে
দিতে। নিজেদের অজান্তে তাই যখন ভবিষ্যতের ভ্রূণ বপন করলাম আমরা, পরে কখনো মনে হয়নি
আমরা কোন পাপ করেছি। কিন্তু লোকের চোখে সেটা ছিল অবশ্যই চরম অপরাধ, তাই আমাদের কত
বড় মুল্য দিতে হবে সেটা সেইসময় আমাদের ধারনাতেও আসেনি। কিন্তু সে তো আরও কিছুদিন
পরের ঘটনা, আমরা তো তখন কিছুই ভাবতে পারিনি, ভাবতে চাইও নি, শুধুই প্রাণ ভরে উপভোগ
করেছিলাম। কিন্তু সাক্ষী? আমাদের ভালবাসার সাক্ষী কি কেউ ছিলনা প্রকৃতি ছাড়া? ছিল
তো। আমাদের চোখের আড়ালে আর একজন ছিল যে সব কিছু দেখেছিলো, সেই বুড়ো স্যামুয়েল। ছোট বেলা
থেকে আমাদের এই একজনই দেখেছিলো, যে বুঝেছিলো যে আমাদের সম্পর্কটা কোনোদিনই মনিব-ভৃত্যের ছিলনা, যেটা
কিনা আমরাই বুঝতে পারিনি। বৃদ্ধ খুশী হয়েছিলো, কিন্তু পরক্ষনেই তার কপালে
চিন্তার বলিরেখা প্রকট হয়েছিলো।
একেই হয়ত সৌভাগ্য বলে যে সেদিন রাতে আমায় কেউ
খোঁজেনি দুজন ছাড়া। হ্যাঁ, এডওয়ার্ড খুঁজেছিল, কারন আমি অনেকক্ষণ অনুপস্থিত ছিলাম
নাচের আসরে। তাকে সামলেছিল বিয়াত্রিচে, বলেছিল আমি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় ঘরে চলে
গেছি। শুভরাত্রি জানিয়ে চলে গেছিল এডওয়ার্ড। আর একজন ছিল বিয়াত্রিচে নিজেই। সে
আমায় খুঁজেছিল সারা প্রাসাদ ঘুরে নিঃশব্দে। না পায়নি, কারন সে জানত না তখনও যে আমি
কোন আস্তাবলে রাত কাটাতে পারি। সে খুব চিন্তিত হয়েছিলো, কিন্তু ভীষণ ধৈর্য ধরে সকাল
অবধি অপেক্ষা করেছিলো, ভরসা করেছিলো যে আমি নিশ্চয়ই ফিরে আসব। সে যদিও জানত যে সকালের মধ্যেও আমি না ফিরলে তার
ওপর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে, কিন্ত তার বিশ্বাস ছিল, আমি আসবই। আমি এসেছিলাম,
প্রথম আলো ফোটার সময়, আধা আলো আধা অন্ধকারে আমি ফিরেছিলাম, সবাইকে আড়াল করে কিন্তু
একজনকে লুকাতে পারিনি, বিয়াত্রিচে দরজা আটকে জেগেছিল সারা রাত। স্বস্তি পেয়েছিল
মেয়েটা, আমায় বিশ্বাস করে ঠকেনি, তাই আজীবন সেই বিশ্বাসের মর্যাদা রেখেছিল। আমার
সেই রাতের গোপন অভিসার সবটাই জেনেছিলো আমার কাছ থেকে, আর চূড়ান্ত ভীতি নিয়েও আমায় ছায়ার মত
অনুসরন করেছিলো।
আচ্ছা তোমরা আমার এই গল্প শুনছো কেন? কি করবে
এই গল্প নিয়ে? আলোচনা করবে, বিশ্লেষণ করবে, ইতিহাস গাঁথবে? কিন্তু আমি কি পাবো?
শেষ মুহূর্ততেও তো শুধু দিয়েই গেলাম আমরা, আমাদের দুর্গ আজ তোমাদের কংক্রিটের
ভিতের নীচে চাপা পড়ে গেছে। আমাদের রক্তাক্ত ইতিহাস তোমাদের ভ্রাম্যমান বইএর পাতায়
বিক্রি হয় একটা লাইনে। কিন্তু আমাদের ভালবাসা? সবাইকে বিরক্ত করেছিলো। আমাদের ভালবাসা? সবাইকে চিন্তিত করছে।
তোমরা পাগল ভাবছ আমায়, ডাক্তার দেখাচ্ছ, কিন্তু কেন আমার সুপ্ত স্মৃতিগুলো কবর
থেকে খুঁড়ে উপড়ে আনছো? আমি যদি বইতে না পারি এই ভার? তোমরা বইবে? আমি যে ব্যাথা নিয়ে আবার জন্ম
নিলাম, সেই ব্যাথা তো শুধু আমার একারই থাকবে, তোমরা তো অনুভব করবে না, ভাগ নেবে
না, আমার লেনিকে এনে দিতে পারবে না, আমার জন্য আমার ইতিহাস লুকিয়ে নতুন সংসার
পাততে সাহায্য করবে-জোর করবে, আমি বাধ্য হয়ে মেনে নেব, বাঁচতে পারব না...... তাহলে
কেন জানতে চাইছ? কিন্তু বলতে শুরু করেছি, শেষটাও আমিই করবো, খুব কষ্ট হচ্ছে মনে
করতে, কিন্তু আমি করবই। আমি পৃথিবীকে জানিয়ে যাবই লেনির কথা, ছোট্ট আশীর্বাদ এর
কথা, আমাদের বেঁচে থাকার চেষ্টার কথা। হ্যাঁ, চেষ্টাই তো। যতরকম ভাবে নিজে নিজেকে, একজন অন্যজনকে বাঁচাতে চেষ্টা করতে পারে, আমরাও করেছিলাম। কাউকে দোষ
দিইনা আমরা, আমরা জানতাম আমাদের কেউ ছেড়ে কথা বলবে না। আমি যদিও বা পাবো, কিন্তু
লেনি? ওকে কে বাঁচাবে? আমার কোন কথাকেই ওরা ধর্তব্যের মধ্যেই আনবে না। ওরা মানে,
সমাজের উঁচু স্তরের মানুষগুলো। কিন্তু ধরা পড়বার সময় যে এসেই গেল। কতই বা বয়স
আমার, চোদ্দ-পনের? আর ওর? কুড়ির কোঠায়। আমরা জানতাম না কিন্তু সময় জানত কখন কি হতে
পারে। তাই সব লুকানো খবর লোকের চোখে ধরা পড়ার সময়টাও যে এসে গেল। আমায় জানাল
বিয়াত্রিচে আর লেনিকে বৃদ্ধ স্যামুয়েল।
এই তিন মাসে আমরা নিজেরা দেখা করেছি বহুবার।
প্রতি রাতে লেনি আসতো আমার ঘরে। বিয়াত্রিচেও থাকতো। লেনি তার অভিজ্ঞতার গল্প বলত,
আমরা শুনতাম, আমার আর বিয়াত্রিচের জন্য লেনি নিত্যনতুন জিনিস তৈরি করে আনতো। কিন্তু সেসবের মধ্যেও আমরা কখনো কখনো একা থাকতাম, ওর কাঁধে মাথা রেখে গল্প করতাম, ভয় পেতাম, কষ্ট পেতাম এই ভেবে যে আমার
কিছুদিনের মধ্যেই এডওয়ার্ড এর সাথে বিয়ে হয়ে যাবে। আর সেই দিনটাও এগিয়ে এলো ক্রমশ। আশার আলো
দেখালো বিয়াত্রিচে,
আজকের যুগে যেটা আকছার ঘটে, সেই সময় তার ফল খুব খারাপ হতো, কিন্তু আমি রাজী হয়ে গেছিলাম।
লেনির অদম্য আকর্ষণ আমি কিছুতেই কাটাতে পারতাম না। কিন্তু কেন? কেন আমি লেনি কে এত
কামনা করতাম! লেনি আর পাঁচটা সাধারন ছেলের থেকে আলাদা নয়, ওর চোখে মুখে একটা
সারল্য ছিল। নিচু তলার মানুষেরা আমাদের সাথে সহজে মিশবে, এটা আমরা বা ওরা কেউই কল্পনা
করতে পারতাম না, লেনির মধ্যে কিন্তু সেই বাধাটা একবারই এসেছিলো, আস্তাবলে। তার
আগে বা পরে কোনদিনই আমার সাথে মিশতে গিয়ে ওর মনে সেই ভীতিটা আমি দেখিনি।
আমরা পালিয়েছিলাম, বিয়ের রাতের ঠিক তিন দিন
আগে। না পালিয়ে আমি কি করতাম? এডওয়ার্ড এর সাথে বিয়ে করে তো আমি সুখি হতে পারতাম
না। তবু সেটাও হতো যদি না লেনি আবার ফিরে আসতো, আর আমায় চুরি করে নিতো। কিন্তু যত আমার আর
এড এর বিয়ের দিন এগিয়ে এসেছে, আমি ভেঙে
পড়েছি। ভেঙে পড়েছি লেনির জন্য প্রধাণত। লেনির সাথে আমার সম্পর্কটা কেউ মেনে নেবেনা। বাবাকে
বলার কোন প্রশ্নই ওঠে না। তিনি আমায় যতই ভালবাসুন, এই অপরাধ তাঁর পক্ষে মেনে
নেওয়া--- অসম্ভব। লেনিকে মৃত্যুর মুখে পড়তে হবে। মাবেল, আমি ওকে কেন জানি ঠিক
বিশ্বাস করতে পারিনা। আমাদের পরিবারের এক বিশ্বস্ত পরিচারিকা। এডওয়ার্ড আমার বন্ধু
হলেও ও একটা জ্যান্ত মূর্তি সম্ভ্রান্ত বংশের। তাহলে আর কে আছে আমরা যার সাহায্য
নিতে পারি? বিয়াত্রিচের বয়সওতো বেশি নয়, তাহলে? লেনি সাহায্য পেয়েছিলো, ছেলেটাকে একজন
ভীষণ ভালবাসত, সেই বৃদ্ধ স্যামুয়েল। এছাড়া আমাদের পিছনে আর কেউ ছিলনা,
পরিকল্পনাটাও ছিল তাঁরই। আর তারপর এলো সেই রাত...
কিন্তু তার আগেই বিয়াত্রিচে কয়েকদিনের ছুটি
নিয়ে চলে যায় তার গ্রামে, কারন আমরা জানতাম, আমি নিরুদ্দেশ হলেই প্রথম ডাক পড়বে
মাবেল আর বিয়াত্রিচের। আর সেই রাতে, আমি অপেক্ষা করছিলাম আমার চিরপরিচিত জানলাটায়।
ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছিল। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম, তারপর কখন ঘুম এসে গেছিলো, হঠাৎ কোন
আওয়াজে জেগে উঠে দেখি, জানলা টপকে ঘরে ঢুকেছে লেনি। কোনোরকমে লেনির হাত ধরে জানলা
থেকে সামনের ঘেরা ঝুলবারান্দাটায় নেমে আসি। নীচে কেমন পাহারা আছে জানিনা।
ক্যাসেলটা প্রথমে, তারপর যে পরিখাটা আছে সেটা, সেটা পেরোতে পারলে... আমার উত্তেজনা
আর ভয়ে দম আটকে আসছিল। কি দুরন্ত গতিতে একটার পর একটা বারান্দা, উঠোন সব পেড়িয়ে
গেল লেনি আমায় নিয়ে! পাহারা দিচ্ছিল যারা, তাদেরকে ধোঁকা দিয়ে। এরপর এলো প্রধান
ফটক। দেখি আগে থেকেই সেখানে অপেক্ষা করছিল বৃদ্ধ স্যামুয়েল। সঙ্গে একজন ওনার
সহকারী। লেনিকে বৃদ্ধ একটা ঝোলা আর একগাছা দড়ি দেয়, তারপর ওদের মধ্যে ফিসফিস করে
কি কথা হয় আমি শুনতে পাইনি। পিছন দিকের একটা ছোট দরজা দিয়ে বেড়িয়ে যাই আমরা।
পরিখাটা পার হবার জন্য ছোট একটা ডিঙ্গি মত আছে দেখলাম সেখানে। তখন মাথায় কিছু
আসেনি, কিন্তু পরে মনে হয়েছিল ওগুলো এখানে কি করে এলো? কারন পরিখাটা আমরা পার হতাম
একটা কাঠের সেতুর ওপর দিয়ে, যেটা সন্ধ্যের পর উঠিয়ে নেওয়া হত আর আমাদের কাসেলটা
পরিপূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। সেই ডিঙ্গি করে আমরা ভীষণ আস্তে আস্তে পার হয়ে
যাই। কি অপরিসীম ভয় জমা
হচ্ছিল মনের মধ্যে, আজও ভাবতে বসলে শিরশির করে
ওঠে শরীরটা। প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল এই বোধ হয় কেউ দেখে ফেললো, এই বোধ হয় আমরা
ধরা পরে গেলাম। পরিখাটা যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকে বেশ কিছুদূর অতিক্রম করলে পরে
আমাদের জমিদারীর চাষবাস। স্থানে স্থানে ফাঁকা নয়ত ফসল ভরা মাঠ, চাঁদের আলোয় সব
স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। এই অবধি আমি আমার জানলা থেকেই দেখেছি, কিন্তু তারপরের রাস্তা
আমার একদম অজানা, একদম অচেনা। আমি শেষ বারের মত একবার পিছন ঘুরে দেখি, আমার ভীষণ
চেনা জগতটা একটু একটু করে দূরে সরে যাচ্ছে। মাঠের শুরুতেই দেখি একটা ঘোড়া বাঁধা
আছে। লেনি সেই ঘোড়াটার দিকে এগিয়ে গেছিল। বুঝলাম ওটাও লেনির পরিকল্পনাতে ছিল।
আমাকে সামনে উঠিয়ে লেনি ঘোড়াটার পিঠে উঠে পড়লো, তারপরই যতটা দ্রুত সম্ভব ঘোড়া
ছুটিয়ে দিল।
আমার জীবনের একটা অধ্যায় শেষ হয় এখানেই। অনেকে হয়ত
ভেবেছিলো, কি এমন হয়েছিল আমাদের মধ্যে যে আমায় সব ছেড়ে
পালিয়ে যেতে হয়েছিলো; কিন্তু আমি তাদের বোঝাতে পারিনি যে আমি লেনির
মাধ্যমে একটা দমবন্ধ করা পরিবেশ থেকে সরে আসতে পেরেছিলাম। লেনি আমায় বাঁচতে
শিখিয়েছিল, কিভাবে জানিনা, তবে মনে হয়েছিলো ও না থাকলে আমি একটা যন্ত্র হয়ে যেতাম। আর বাকিটা
ছিল আমাদের ভালবাসা। লেনি আমায় বিনা শর্তে ভালবেসেছিল নিজের মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে, আর
আমি... ওর জন্য আমার পৃথিবীকে ছেড়ে দিয়েছিলাম।
(ক্রমশ...)
pou.... ebaro osadharon lekha likhechhe...
ReplyDeletekhoob valo laglo...