।। চিঠি ।।
~ অনির্বাণ
চক্রবর্তী ~
(১)
নীরা,
আজ কলেজ থেকে বাড়িতে ফেরার পর
সারাক্ষণ খালি ঘর বাহির করেছি। কি করবো কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। মনের মধ্যে অনেক
কথা জমে আছে, আর প্রতিনিয়ত তা বেড়েই চলেছে। বলতে খুব ইচ্ছা করছে, কিন্তু বলার উপায়
পাচ্ছি না।
হটাৎ হাতের কাছে পুরনো ডাইরী টা পেয়ে
মনে হলো কথা গুলো লিখে রাখি। যা আমি তোমায় বলতে চাই, যে কথা আমার মধ্যে প্রতিদিন
একটু একটু করে জমে যাচ্ছে, সেগুলো কে লিপিবদ্ধ করি। তারপর এই পাতা ছিঁড়ে তোমার
হাতে দিয়ে দেবো। হয়ত আমাকে তোমার ভীতু মনে হতে পারে, কিন্তু কি করবো! তোমায় দেখলেই
আমার গলা শুকিয়ে যায়, কথা বলতে গেলে ভাষা হারিয়ে ফেলি, কথা আটকে যায়। তাই এই কয়েক
মাসের মধ্যে আমি এক মাত্র তোমার সাথেই কোনও কথা বলতে পারিনি। আমি আমার ক্লাসের
সবার কাছে হিরো হতে পারি বা সবাই আমাকে সাহসী মনে করতে পারে, তবে কেন জানিনা, তুমি
সামনে এলেই...
এই লেখা শুধু তোমার জন্য, হ্যাঁ নীরা, শুধুই তোমার জন্য...
“তোমায় কিছু বলতে চাই, বলি কিছু অন্য,
নতুন করে লিখতে বসেছি,
শুধু তোমারই জন্য।“
আজ তোমার জন্য কবিতা লিখতে বসলাম। আজ
পর্যন্ত শুধু গাছপালা, পাখী, প্রকৃতি ছাড়া কোনও কিছু নিয়ে কবিতা লিখতে পারিনি।
জানিনা কোনও এক অদৃশ্য শক্তিতে আমি আজ কবিতাটা লিখে ফেললাম। বেশ কয়েকটা লাইন লিখে
ফেলেছি, তবে পুরোটা এখন বলব না। তোমার জন্মদিনের জন্য এটা তুলে রাখলাম। সেদিন এই
কবিতাটা তোমায় উপহার দেবো। কারন, এটা শুধু তোমারই জন্য।
কলেজে প্রথমদিন থেকেই অচিন্ত্য ও সুজন এর সাথে আলাপ হয়েছিলো। আসলে আমি আর
ওরা দুজনে ছাড়া ক্লাসের আর কেউ সিগারেট খায় না। তাই সিগারেট খাওয়ার মাধ্যমে ওদের
সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। সুজন আমাদের জিজ্ঞাসা করেছিলো আমরা কে কাকে পছন্দ করি, বা
কাকে ভালো লাগে। আমি তোমার নাম বলি। অচিন্ত আর সুজন একে একে ওদের পছন্দের মেয়ের
নাম বলল, তবে আমি তোমায় ওদের নাম বলব না। ওরা আমার মতো ভীতু নয়, ওরা নিজেরাই বলবে
ওদের পছন্দের মেয়েদেরকে। সুজন আমাকে হটাৎ জিজ্ঞাসা করলো আমি তোমাকে কেন পছন্দ
করলাম। আমি কারণ খুঁজে পেলাম না, আর তাই উত্তরও দিতে পারলাম না। আজ এক মাস পরেও
আমি এর সঠিক কারণ জানিনা। আসলে আমি একটা স্বপ্ন দেখতাম, একটি মেয়ের। যার সাথে আমি
আমার সব কথা বলতে পারতাম। সে ও আমার সব কথা শুনত, খুব কম কথাই বলত। তোমায় যেদিন
প্রথম দেখলাম, চমকে উঠলাম। তুমি আর আমার স্বপ্নপরী অবিকল একই রকম। সেও ঠিক তোমার
মতন আমার সামনে এলেই চোখ নামিয়ে নিত, তোমার মাথার চূলও ঠিক ওর মতন লম্বা, কপালের
ওই ছোট্ট টিপও একই রকম। আজ নবীন বরণে তুমি যেভাবে শাড়ি পড়ে এসেছিলে ও ঠিক এই ভাবেই
শাড়ি পড়ে। নিজেকে পাগল বলে মনে হচ্ছিল। এ কি করে হতে পারে? স্বপ্ন কি তাহলে সত্যি
হয়?
“ সবাই চুপ ছিল,
আসলে তোমায় ভালোলাগায়,
ওরা অবাক হয়ে গেছিল”।।
আমাদের ক্লাসের
সিনিয়ররা নবীন বরণের দিনক্ষণ ঠিক করে আমাদের সাথে আলোচনা করতে এলো। আমাদের
অনুষ্ঠানের দিনক্ষণ জানিয়ে নাচ ও গানে অংশগ্রহণ করতে বলল। গানের দায়িত্ব নিল শ্রেয়া, নাচের টা ভাস্বতী।
অভিনয়টা আমি নিতাম, কিন্তু সময় বেশী নেই, তাই নাটক বাদ। আমরা উদ্বোধনী সঙ্গীত গাইবো,
তাই ঠিক হল ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে’ গান টা গাওয়া হবে। এছাড়া পরে ‘ভালো লাগে
স্বপ্নের মায়াজাল বুনতে’ গানটাও আমরা গাইবো। গোল বাঁধল দ্বিতীয় গানটা নিয়ে, ওটা
শুধুমাত্র আমি আর শ্রেয়া জানি। তাই আমরা দুজনে ক্লাসের সবাইকে গানটা সবাইকে
শেখানোর দায়িত্ব নিলাম। আমি শ্রেয়াকে বললাম তোমাকেও গানের দলে নেওয়ার জন্য। ও
কারণটা বুঝতে পারলো, আর মুচকি হাসলো। এইরে! আমি ধরা পড়ে গেলাম!!
এদিকে
ভাস্বতী আমাকে ওর সাথে একটা গানে নাচতে বলল। আমি বললাম- আমি কখনো নাচিনি, তাই
নাচতেও পারবো না।
ও বলল- ভাসানেও নাচিস নি!
আমি বললাম- না।
ও বলল- চেষ্টা কর, আমিও তো গান না শিখেও তোদের সাথে গাইছি।
আমি বললাম- পারব না।
ও মন খারাপ করে চলে গেল। আমি ওকে বোঝাতেই পারলাম না যে আমার
নাচতে ভাল লাগে না। কোনও কিছুকে জোর করে ভালোলাগাতে গেলে সেটা কৃত্রিম ভালোলাগা
হয়ে যায়, আর আমি এটাকে অপছন্দ করি। যা সাবলীল ভাবে আসে না, সেটা কখনো সুন্দর হতে
পারে না।
গানের
রিহার্সালএ আমি টেবিল বাজাচ্ছিলাম আর শ্রেয়া ‘ভালো লাগে স্বপ্নের মায়াজাল বুনতে’
গানটা গেয়ে শোনাচ্ছিল। আমিও ওর সাথে গাইছিলাম, আর তোমার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। হটাৎ
সবাই চুপ করে গেল, আর আমি গেয়েই চললাম। তারপর খেয়াল হল, আমি দ্বিতীয় লাইনটা না
গেয়ে তৃতীয় লাইন থেকে গাইছিলাম। সবাই আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে, শ্রেয়া চোখ বড়
বড় করে তাকালো আর তাকালে তুমিও।
“বৃষ্টিস্নাত সূর্যের মত, স্নিগ্ধ
তোমার দৃষ্টি,
কি অপূর্ব সৃষ্টি।
হাতড়ে বেড়াই কবিতার খাতা,
ভাষা বাধা দেয়, উফ! কি যাতা,
লজ্জায় তোমার চোখ নামানো, আরও মধুর-
মিষ্টি,
কি অপূর্ব সৃষ্টি”।
দেখতে দেখতে
আমাদের নবীন বরনের দিন এগিয়ে এলো। অনুষ্ঠানে আমরা শুধু গানই গাইবো, নাচ হবে না। ভাস্বতী নাচবে না বলেছে। আমি ওকে অনেকবার
বোঝানোর চেষ্টা করেছি, কিন্তু ও বুঝতে চাইলোই না।
আমি বললাম- তুই দিপাঞ্জনের সাথে নাচ, কারন ও তো নাচতে জানে
(তাছাড়া দিপাঞ্জন ভাস্বতীকে পছন্দ করে)।
ও জবাব দিল- না।
হটাৎই খবর পেলাম ভাস্বতী অন্য একটি কলেজে ভর্তি হয়েছে। মানে
আমরা ২৪ জন থেকে ২৩ জন হয়ে গেলাম। খুব খারাপ লাগছিল, একবার তো জানাতে পারত, একবার
তো বলে যেতে পারত।
নবীন বরণের দিন
আমি কলেজে তাড়াতাড়ি গেছিলাম, তারপর সিনিয়রদের সাথে আমাদের ক্লাস রুম সাজাতে
সাহায্য করলাম। এক এক করে বন্ধুরা ক্লাসে ঢুকতে শুরু করলো। মেয়েরা শাড়ি আর ছেলেরা
পাঞ্জাবী পড়বে, এটা আমাদের আগে থেকেই বলে দেওয়া ছিল। তুমি ক্লাসে এলে, খুব অপূর্ব
লাগছিল তোমায় দেখতে। আমি কাজের ফাঁকে ফাঁকে তোমার দিকে তাকাচ্ছিলাম। কিছুক্ষন পরেই
অনুষ্ঠান শুরু হল। এবং আমরা ও সিনিয়ররা বেশ ভালোই অনুষ্ঠান করলাম। অনুষ্ঠান শেষ
হওয়ার কিছু আগে স্যার ম্যাডামরা কলেজ থেকে বেরিয়ে গেল।
এর পরেই র্যাগিং শুরু হলো। আমি পুরো
ব্যাপারটাই সহ্য করতে পারছিলাম না। এমন সময় সব্যসাচীদা তোমাকে ডেকে বলল ‘I Love You’ বলতে। আমি চুপ ছিলাম। যখনই কিছু বলব বলে উঠছি তখনই
অচিন্ত্য ও সুজন আমাকে আটকাচ্ছে, আমার পাশে কোনও সমর্থন নেই। অচিন্ত্য ও সুজন
নিজেদেরকে পাড়ার দাদা বলে, দেখে তো ওদের সিনিয়রদের চামচা মনে হচ্ছিল। ওরা নিজেরা তো চুপ
ছিলই, উপরন্তু আমি যখনই প্রতিবাদ করব বলে উঠছি তখনই ওরা বাধা দিচ্ছে। আমি একা আর
সিনিয়ররা প্রায় চল্লিস জন। নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছিল, এমনকি সিনিয়াররা আমায় যখন
র্যাগিং করেছিল তার চেয়েও বেশী অসহায় লাগছিলো। আমি আর চুপ থাকতে পারলাম না।
চেঁচিয়ে বললাম- ‘এসব কি হচ্ছে? এখনই বন্ধ করো, নাহলে আমি কলেজের ছাত্র সংসদ ও
অধ্যক্ষ কে জানাবো। তোমাদেরকে ছাড়ব না’। তখন কিছু ভালো সিনিয়ার (যারা এই র্যাগিং এর বিরুদ্ধে ছিলো)
আমাকে সমর্থন করে। আমি এই সুযোগে ক্লাসের দরজাটা খুলে দিলাম ও তোমাদের সব্বাইকে
বেরিয়ে আসতে বললাম।
বেরনোর সময়
তুমি আমার হাত ধরে বলেছিলে ‘Thank You’। সেই প্রথম তোমার
সাথে আমার সামনা সামনি কথা। সত্যি, তোমার গলাটা খুব মিষ্টি শোনাচ্ছিল। আমার রাগী
মেজাজটা কোথায় যেন পালিয়ে গেল আর মাথাটাও ঠাণ্ডা হয়ে গেল। রাত অনেক হয়ে গেছে, তাই
আর কোনও কথা বাড়ানো হলো না। তোমাদেরকে বাসে তুলে দিয়ে আমি আমার বাড়ির উদ্দেশ্যে
রওনা দিলাম। পুরোটা রাস্তাই খালি তোমার কথাই ভাবলাম। তোমার বলা ওই ‘Thank You’ কথাটা বার বার আমার কানে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো। এত
মিষ্টি কথা আমি আর মাত্র একজনের কাছ থেকেই শুনেছি। সে আমার স্বপ্নের নীরা, যাকে
আমি খুব ভালোবাসি।
উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম,
অনির্বাণ
(২)
প্রায় ৩ মাস কেটে গেল, কোনও উত্তর
পেলাম না। মাঝে মাঝেই ডাইরির পাতাটা উল্টাই, আর ছেঁড়া পাতার অংশবিশেষএ চোখ চলে
যায়, আর মন খারাপ হয়ে যায়। এখনও আমার সেই সাহসটা এলোনা যে আমি নীরা কে সামনা সামনি
জিজ্ঞেস করবো বা আমার মনের কথাটা তুলে ধরবো।
নবীন বরণের পরের দিন কলেজে যেতে আমার দেরী
হয়ে গেছিলো। ক্লাসে গিয়ে দেখি খুব হই হট্টগোল চলছে। সুজন সব্বাইকে বোঝানোর চেষ্টা
করছে যে আগেরদিন যেটা হয়েছে সেটা স্বাভাবিক, এবং এটা সব জায়গাতেই হয়। তাই
আগেরদিনের ব্যাপারটা মেনে নিয়ে আমরা যেন সিনিয়রদের সাথে ভালোভাবে কথা বলি। আমি
প্রতিবাদ করলাম। বললাম- সব জায়গাতেই হয় বলে যেটা ভুল সেটা মেনে নেব? আমি কখনও ভুল
বা অন্যায় মেনে নিই না।
সুজন বলল- তাহলে কি করবি, মারামারি?
আমি বললাম- না। তবে ওরা যে আমাদের সিনিয়র, এটাকে অস্বীকার
করবো।
সুজন বলল- কি করে? ঠিক বুঝলাম না।
আমি বললাম- ওদের আমরা বয়কট করবো, ওদের সাথে কোনও কথা বলব
না।
নীরাই প্রথম আমাকে সমর্থন করলো, তারপর বাকিরা। তবে সুজন
ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলো।
নীরাকে আজও বেশ ভালোই লাগছে,
আগেরদিনের চিন্তা ও ভয়ের রেশটা কেটে গেছে। স্থির করলাম চিঠিটা এইবার ওর হাতে দিয়ে
দেবো। এমন সময় ম্যাডাম ক্লাসে ঢুকলেন। ক্লাস শেষে সুজন ও অচিন্ত্য ডাক দিলো
ক্যান্টিনে যাওয়ার জন্য মানে সিগারেট খাওয়ার জন্য। ক্লাস থেকে বেরোনোর আগে আমি
নীরার দিকে তাকালাম, চোখে চোখ পড়ে গেলো। নীরাও কি আমার দিকে তাকিয়েছিল?
ক্যান্টিনে সুজন আমাকে আবার বোঝাতে
শুরু করলো।
ও বলল- সিনিয়রদের সাথে থাকলে, তেল মারলে ওরা আমাদের
প্রাক্টিক্যাল খাতা বা নোটস দেবে। তাহলে অনেক খাটনি কমে যাবে, অনেক কম সময়ে কাজ
হয়ে যাবে।
আমি বললাম- না। আমি দ্বিগুণ খাটতে রাজি আছি, কিন্তু ওদের
সঙ্গে কোনওরকমের আপোষ করব না।
সুজন আমাকে কিছুতেই দমাতে না পেরে চুপ করে গেলো। তারপর আমি
ক্লাসে এসে বললাম- তোরা চাইলে সিনিয়রদের সাথে যোগাযোগ রাখতে পারিস, তাতে আমার কোনও
আপত্তি নেই। কিন্তু আমি রাখবো না, এটা আমার ব্যাক্তিগত সিদ্ধান্ত। ক্লাসের সবাই
(সুজন ছাড়া) আমার সিদ্ধান্তে সম্মতি জানালো।
সেদিনই ক্লাস
শেষে আমি নিজের মধ্যে কিছুটা সাহস জুগিয়ে নীরার ব্যাগে চিঠিটা ঢুকিয়ে দিই আর
নীরাকে জানাই ও বাড়ি গিয়ে পড়তে বলি। ওর সাথে কথা বলতে গিয়ে আমার গলা শুকিয়ে গেল আর
আমি তোতলাতে শুরু করেছিলাম। ইস! ও কি আমাকে তোতলা ভাববে? জানিনা ও বাড়ি গিয়ে পড়েছে
কিনা। কিন্তু একবার তো জানাতে পারত, ও পড়েছে কি পড়েনি। অথবা জবাব তো দিতে পারত।
তাহলে অন্তত আমাকে এত চিন্তায় পড়তে হতো না।
পরের
সপ্তাহটা নীরা কলেজে আসেনি। শ্রেয়ার কাছ থেকে জানতে পারলাম যে নীরার জ্বর হয়েছে।
খুব ইচ্ছে করছিলো ওকে দেখার। বুঝতে পারছিলাম না কি করব! তারপর শ্রেয়ার কাছ থেকে
নীরার টেলিফোন নম্বরটা পেয়ে গেলাম। বাড়ি ফিরেই ল্যান্ডফোনটা তুলে নিয়ে রিং করলাম,
আর রেখে দিলাম। সাহস পাচ্ছিলাম না। ফোন ধরলে কি বলবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। বাড়ি
থেকে বেরিয়ে একটা সিগারেট খেতে গেলাম। এই সুযোগে কি বলবো তা ভেবে নিলাম। সামনেই
একটা পাবলিক টেলিফোন বুথ দেখতে পেয়ে ঢুকলাম। কিন্তু কাজ এগোলো না। আবার ফোনটা রিং
হতেই রেখে দিলাম। থাক, বাড়িতে ফিরেই ঠাণ্ডা মাথায় ফোন করবো। কিছুক্ষন বাইরে
ঘোরাঘুরি করে বাড়িতে ঢুকেই ফোনটা তুলে নিলাম। আর মনে মনে বললাম- ভয়ের কোনও কারন
নেই, সব ঠিকঠাকই হবে। ফোনটা রিং হতেই একজন ফোন ধরে বললো-
ইয়ার্কি হচ্ছে!! বারবার মিস কল দেওয়া!!! কে তুমি? কে? বাড়ি
কোথায়??
আমি বলতে গেলাম-
আমি নীরার বন্ধু। কিন্তু কথাটা ‘আ-আ-আ’ থেকে আর এগোতে পারলো না।
আবার ফোনটা রেখে দিলাম। খুব জোরে জোরে নিঃশ্বাস বেরোতে
লাগলো। হৃৎপিণ্ডটাও খুব জোরে চলতে লাগলো। সারা শরীর দিয়ে ঘাম ঝরছে, ঠিক জ্বর নামার
সময় যেমন হয় তেমনি। এমন সময় রান্না ঘর থেকে মা এসে উপস্থিত।
মা বলল- কি হয়েছে?
আমি বললাম- মনে হয় অ্যাসিড হয়েছে।
মা বলল- তাহলে রাতে জল আর মুড়ি খেয়ে ঘুমিয়ে যা, রাতে
মাছ-ভাত আর খেতে হবে না। অগত্যা সেই রাতে খালি মুড়ি আর জল খেয়েই কাটাতে হলো।
(৩)
জ্বর থেকে সুস্থ হয়ে নীরা কলেজে এল।
হাল্কা নীল রঙের শালোয়ার কামিজ, কপালে একটা ছোট্ট টিপ আর মাথার চুলটা খোলা। আমি
কোথায় যেন হারিয়ে গেলাম। নিজের মধ্যে কবি ভাবটা কেমন যেন জেগে উঠলো।
“আকাশ আমায় হাতছানি দেয়,
সবার সাথে আজ আড়ি।
হাতটা আজ বাড়াও তুমি,
মেঘে দিই পাড়ি।
কালো মেঘের মত তোমার,
ঘন কেশ রাশি।
কোথায় যেন হারিয়ে যাই,
দেখলে তোমার হাসি”।।
চুপচাপ বসে বসে ভাবছিলাম আর কল্পলোকে
বিচরণ করছিলাম। শ্রেয়ার চেঁচামেচিতে পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়লাম। শ্রেয়া আমাকে আমার
নাম ধরে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডাকছিলো। আসলে আমি ওর কথায় কোনও কান দিচ্ছিলাম না।
শ্রেয়া একটা
খেলা (?) আবিষ্কার করেছে, যেটাতে এইকদিন আমরা বেশ আনন্দের সঙ্গে অংশগ্রহণ করেছি।
খেলাটা এই রকম, প্রতিদিন যেকোনও একটা বিষয়ের উপর আলোচনা হবে। এবং সেখানে সব্বাইকে
স্টেজে উঠে অংশগ্রহণ করতে হবে। এই খেলার একটাই শর্ত, বিষয়টা অবশ্যই সিলেবাসের
বাইরে হতে হবে। এই খেলার মাধ্যমে আমাদের নিজেদের মধ্যে একটা সুন্দর যোগসূত্র গড়ে
উঠেছিল। আমরা সবাই সবাইকে
জানতে ও বুঝতে শুরু করেছিলাম। আমাদের অনেক অজানা তথ্য এই খেলার মাধ্যমে জানতে
পারতাম। শিবাশীষ, আমরা শিবা বলেই ডাকতাম, ও বেশ ভালোই বলতে পারতো। সেদিনের বিষয়
ঠিক হলো- কার কি রকমের ছেলে বা মেয়ে পছন্দ। মোদ্দা কথা হল নিজের জীবনসঙ্গী বা
জীবনসঙ্গিনী কি রকম আশা করে? এর আগে কারা কি বলে গেছে কিছুই কানে ঢোকেনি। এখন আর
তিনজন বাকি। আমি, শিবা আর নীরা।
আমি স্টেজে উঠলাম, ঠিক যে জায়গাতে
স্যারেরা দাঁড়ায়। শ্রেয়া আবার চেঁচিয়ে বলল- এবার তাড়াতাড়ি বল, ক্লাস শুরু হয়ে যাবে তো।
আমি বললাম- ছোট্ট টিপ, লম্বা চূল আর যামিনী।
সবাই হেসে ফেললো।
শ্রেয়া ধমকের সুরে বলল- will u
explain please?
কথায় কথায় ইংরেজি বলা শ্রেয়ার একটা বাজে অভ্যেস। মাঝে মাঝে
সহ্য করা খুব কষ্টকর হয়ে যায়। কেমন একটা হীনমন্যতায় ফেলে দেয়।
আমি বললাম- ওয়ে, ওয়ার্ডসওয়ার্থ এর নাতনী, আমরা যে ভেতো
বাঙ্গালী, একটু বাংলায় বল। তাহলে আমি ও বাকিরা বুঝতে পারবে।
এই একটা ওষুধ
বেশ কাজ দিচ্ছে। শ্রেয়া ইংরেজি আওড়ালেই সঙ্গে সঙ্গে ওয়ার্ডসওয়ার্থ এর নাতনী বলতে
হবে, তাহলেই চুপ। তবে শর্ত প্রযোজ্য। আমি ছাড়া অন্য কেউ বললেই শুনতে হবে খিস্তি,
তাও আবার ইংরেজিতে। একবার এই ওষুধটা অচিন্ত্য ব্যাবহার করতে গিয়ে সবার সামনে
খিস্তি শুনেছিলো। ভাগ্যিস আমার পকেট ডিকশনারিটা আমার ব্যাগে থাকে। নাহলে বুঝতাম না
অচিন্ত্যকে যেগুলো বলেছে সেগুলো ঠিক কি বস্তু! খায় না মাথায় দেয়!!
বেচারা আচিন্ত্য, ও আবার শ্রেয়াকে
খুব পছন্দ করতো, সেই প্রথমদিন থেকেই। শ্রেয়া দেখলো আনস্মার্ট ছেলে, ইংরেজি জানে
না, তাই চলবে না। ও অচিন্ত্য কে প্রত্যাখ্যান করলো। আর বলল তোকে আমি বন্ধুর মতো
দেখি, ইত্যাদি। অচিন্ত্য কলকাতা শহরতলীর একটা কলোনির ছেলে। নিজেদের একটা ছোট একতলা
বাড়ি আছে। ওদিকে শ্রেয়ার বাড়ি দক্ষিন কলকাতায়। নিজেদের বিশাল বড় একটা বাড়ি।
ছোটবেলা থেকেই ইংরাজি মাধ্যমে পড়া মেয়ে। জানিনা কি কারনে আমাদের কলেজে এসে পড়লো।
মনে হয় ইংরাজি মাধ্যম কলেজে শুধুমাত্র টাকার জোরে ভর্তি হওয়া যায় না। তবে শ্রেয়া
কিন্তু বন্ধু হিসাবে খুব ভালো। ওর ইংরাজি কথাগুলো বাদ দিলে, ওর সাথে আড্ডা মেরেও
মজা।
যাই হোক,
শ্রেয়া বলল- তুই যেটা বললি সেটা একটু বুঝিয়ে বল। কে জানে তুই যার কথা ভাবছিস সেও
হয়তো তোর কথাগুলো শোনার জন্য আগ্রহ নিয়ে বসে আছে। বলেই মুচকি হাসল।
আমি বললাম- মেয়েটা দেখতে বা তার সাজগোজ খুবই সাধারন, তার
লম্বা চুল থাকবে, হাসিটা খুব মিষ্টি হবে আর...
শ্রেয়া বলল- আর??
আমি নীরার চোখে চোখ রেখে বললাম- আর চোখ, নিষ্পাপ কিন্তু
রহস্যপূর্ণ। যে রহস্য উদ্ঘাটন করতে গিয়ে আমি হারিয়ে যাবো। বলেই আমি শ্রেয়ার দিকে
তাকালাম।
শ্রেয়া বলল- তুই কি চক্ষু বিশেষজ্ঞ??
আমি বললাম- মানুষের চোখ মিথ্যে বলতে পারেনা, সত্য গোপনও
করতে পারে না। আর অনেক না বলা কথা বলে দেয়।
এই বলেই আমি আমার নিজের জায়গায় বসে
পড়লাম। আর সঙ্গে সঙ্গেই ম্যাডাম ক্লাস এ ঢুকলো। সেদিনের মতো এই খেলার ইতি। নীরা কি
আমার সেদিনের না বলা কথা বুঝতে পেরেছিলো?
(ক্রমশ...)
Ami er lekhok ke chini na, kintu alap korar opekkhay roilam........surutei hariye dilo
ReplyDeletecool... baki tar opekkhay roilam..
ReplyDelete