Saturday 14 April 2012

Uponyas: Chhotto Aswirbad by Poushali Paul


ছোট্ট আশীর্বাদ... The Little Blezz
পৌষালী পাল

(পূর্বের প্রকাশের পর থেকে)


ঐ রাতের মধ্যেই ক্রমাগত ঘোড়া ছুটিয়েছিল লেনি, আর পার হয়ে এসেছিল আমাদের প্রজাদের চাষবাস, ক্ষেত, জমি জমা। ভোরবেলা পৌঁছে গেছিলাম কাঙ্ক্ষিত জঙ্গলে। একটানা ঘোড়া ছুটিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল ও। ঘোড়াটাও। তাই আমাকে বসিয়ে রেখে ও নিজেই নেমে পড়েছিল ঘোড়া থেকে। কাছাকাছি বোধ হয় একটা নালা মত ছিল, সেখানে ঘোড়াটাকে জল খাইয়ে কিছুক্ষনের জন্য বেঁধে রেখেছিল ও, সামান্য বিশ্রাম নেবার পর আবার শুরু হয়েছিল পথ চলা। আজও মনে পড়ছে সব কিছু স্পষ্ট করে। সবচেয়ে বেশি যেটা মনে পড়ছে সেটা হল ওর যত্ন, আমায় একদম আগলে রেখেছিল ও। একমুহূর্ত কাছ ছাড়া করেনি। ভাল লেগেছিল ভেবে যে আমি ওর কাছে এতটাও দাম ছিলাম। রাতটুকু বিশ্রাম নিতাম আমরা, আর সারাটা দিন ছুটে চলা, মাঝে কোথাও থেমে একটু খাওয়া দাওয়া। প্রতিটা সময় আমাদের মনে হচ্ছিল কেউ নিশ্চয়ই পিছু নিয়েছে আমাদের। কিন্তু নিজেদের শব্দ ছাড়া আর প্রকৃতির কূজন ছাড়া কিচ্ছু শুনতে পাইনি।
তিনদিন পর একটা পাহাড়ী সরু নদীর সামনে এসে ও আমায় ঘোড়া থেকে নামিয়ে নেয়। বলে এরপরের পথটুকু আমাদের হেঁটেই যেতে হবে। ঘোড়াটাকে এখানেই ছেড়ে দেওয়া হবে, আর সেটা নিজের পথ চিনে ফিরে যাবে প্রাসাদে। ঘোড়াটার দিকে যতদূর চোখে পড়ে আমি তাকিয়েছিলাম। চোখ ফেরাতে দেখি লেনি আমার দিকে নির্নিমেষে তাকিয়ে আছে। এই প্রথম ওর দিকে তাকিয়ে আমি লজ্জা পেলাম। নিজের স্বপ্নের রাজত্বে একাকী রাজাকে দেখে যেন লজ্জা পেল তার রানী। আমার সমস্ত সত্ত্বা জুড়ে যে একটা অনুরণন ছিল, সে যেন নিজেই নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছিল এতদিন ভালবাসার নদীতে যে জোয়ার আসছিল, এবার দুর্নিবার বান হয়ে সমস্ত বাঁধ ভেঙে দিল বিশাল অরন্যরাজি কে সাক্ষী রেখে, আমার গর্ভে আমাদের ভালবাসার বীজ বপন হল সে রাত্রে খোলা আকাশের নীচে, ভেজা মাটির ওপরে শুষ্ক পাতার শয্যায়
এরপরের চার দিন আমরা ক্রমশ হেঁটেছিলাম পূর্বদিক বরাবর। আমাদের জীবনের এই চারটি দিন আমি মাটির খুব কাছাকাছি এসেছিলাম, মাটির কাছাকাছি বলতে আক্ষরিক অর্থেই। সুবিস্তীর্ণ জঙ্গলের মধ্যে পাতার শয্যায়, পথ ভুল করে বয়ে চলা নদীর ছোট্ট শাখায় অবগাহন, বনের ফলে খিদে মেটানো বা লেনির বুকে নির্ভয়ে লুকিয়ে থাকা। এত যত্ন করতে পারে ও! যেন নিজের সবচেয়ে দামি জিনিসটা আগলে রেখেছে সামান্য আঘাতে যার অপরিসিম ক্ষতি হতে পারে। লেনির সঙ্গে আমি মাত্র মাস সাতেক থাকতে পেরেছিলাম। কিন্তু তার মধ্যে আমি আমার সবচেয়ে সুন্দর সময় কাটিয়েছিলাম। তারপর সেই ভয়ঙ্কর অভিশাপ... থাক পরে হবে সে কথা। আগে তো এসে পৌঁছনো যাক নির্দিষ্ট গ্রামটাতে। দেখা করা যাক বৃদ্ধ গ্যাব্রিয়েলের সাথে যে কিনা আমাদের স্যামুয়েল এর ভাই হয় সম্পর্কে। আগে তো থাকতে দিক আমাদের নিজের ছোট বাসার কোন একটা জায়গায়।
থাকতে দিয়েছিল সে। চারদিন ধরে জঙ্গল পেরিয়ে ক্লান্ত শরীরে রাতের দিকে পৌঁছেছিলাম গ্রামটাতে। অতি সন্তর্পণে। মনে চূড়ান্ত ভয়, কেউ তাড়া করে আসছে নির্ঘাত। নাহ, আসেনি। বেশি লোকের বাস নেই গ্রামে। আর সারাদিনের কাজের পর খেটে খাওয়া মানুষগুলো হয়ত ঘুমোবার যোগাড়ে লেগেছে। ঘরগুলো বেশ দূরে দূরে, আর সেখান থেকে হালকা আলোর ছিটে বেরিয়ে আসছে। দেখলাম লেনি চেনে তার বাড়ি। আমায় বাইরে রেখে লেনি ভিতরে ঢুকে গেছিল, আর আমি একা একা দাঁড়িয়ে রইলাম। কিছুক্ষন পর বেরিয়ে এসে আমার হাত দুটো ধরে আমায় নিয়ে ভেতরে ঢোকে। কোন গ্রামের সাধারন বাড়ি আমি প্রথম দেখলাম। একটা ছোট্ট মত মাটি, কাঠ আর পাথর দিয়ে তৈরি ঘর, নিচু ছাদ, ঘরের একদিকে একটা উনুন আর তার পাশে কিছু জ্বালানি কাঠ। উনুনে কিছু একটা রান্না হচ্ছে। একজন বৃদ্ধা ময়লা মোটা জামা পরে তার পাশে বসে আছে। তার উল্টোদিকে একটা বুড়ো মানুষ, মুখ ভর্তি সাদা দাড়ি, কিন্তু দুজনেরই মুখে অদ্ভুত স্বর্গীয় হাসি লেগে আছে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, ইনিই গ্যাব্রিয়েল, আর পাশে বসে তার স্ত্রী।
আমাদের দুটিকে পরম আদরে পাশে বসায় ওরা। বাইরের ঠাণ্ডা হাওয়া থেকে থেকে কাঁপিয়ে দিচ্ছিল, এতক্ষণে উনুনের ধারে এসে বেশ আরাম হচ্ছিল। সেই রাত থেকেই আমরা আশ্রয় পাই মানুষ দুটির কাছে ছোট্ট কাঁচা বাড়ি, সাকুল্যে দুতিনটি ঘর। তার মধ্যে একটি বরাদ্দ হয় আমাদের নতুন সংসারের জন্য। সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্মেছিলাম, কিন্তু আপনত্বের স্বাদ কি হয় তা কোনদিনও পাইনি। বাবা বরাবর ব্যাস্ত মানুষ, মাবেল তার পরিচিত গণ্ডির বাইরে কোনদিনও বের হয়নি। আমার একাকীত্বে একটা নতুন প্রাণ এলো লেনির সাথে। খুব সাধারন জীবনের সাথে মানিয়ে নিতে একটুও অসুবিধা হয়নি। কিন্তু আমার সুখটাই একসময় দুঃস্বপ্নে ঢেকে গেল। ভালবাসার জীবনে আবার দেখা দিল এক টুকরো কালো মেঘ। গ্যাব্রিয়েল এর ছেলে উইলি।
লোকে বলে মানুষের সুখের স্মৃতির থেকে দুঃখের স্মৃতিটাই বেশি মনে থাকে, আমারও দুঃস্বপ্নটাই তাড়া করে বেড়ায়। উইলি এলো কয়েকদিন পরে। আর এসেই প্রথম নজর পড়লো আমার ওপর, একই সাথে আমার সংসারের ওপর। লেনি গ্যাব্রিয়েল এর সাথে প্রতিদিন সকালে বেরিয়ে যেত, দুপুরে ফিরে আসতো। কোনদিন বিকালে। বুড়োর সাথে ভুট্টার ক্ষেতে যেত। ভালই চলছিল। কিন্তু লেনি বেরিয়ে যাওয়ার পর এক দুপুরে উইলি এসেছিল আমার ছোট্ট ঘরে। বুড়ি হয়ত গেছিল অন্য কারো বাড়ি। না উইলি আমায় ছুঁতে পারেনি। ভেবেছিলাম কুঁড়ে ঘরে চাঁদ শুধু আলোই দেয়, কিন্তু ভুল ভেবেছিলাম। উইলি সেই ভুলটা আঙুল তুলে দেখিয়ে দিয়েছিল। তাই লেনির অবর্তমানে আমায় শাসিয়ে গেছিল, আমাদের শেষ দেখিয়ে ছাড়বে। সে নিশ্চয়ই জেনেছিল আমি আর লেনি এখানে কেন এসেছি, কোথা থেকে এসেছিসরল বুড়ো-বুড়ি কোন কারন খুঁজে পায়নি নিশ্চয়ই ছেলের থেকেও লুকিয়ে রাখার। আর সেটারই সদ্ব্যবহার করেছে উইলি। আমি দেরী করিনি, লেনি আসার সাথে সাথেই জানিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু লেনির চোখ অদ্ভুত বিষাদগ্রস্থ হয়ে গেছিল। কি জানি কি চলছিল ওর মনে, যেন অনেক কষ্ট তোলপাড় করছিল, কিন্তু আড়াল করার চেষ্টা করছিল আমার থেকে। পরে বুঝেছিলাম সেটা ছিল আমায় হারাবার ভয়। কি অসম্ভব রকমের একটা মানুষ ভালবাসতে পারে সেটা ওর চোখ দুটোই বলে দিচ্ছিল যেন। লেনিকে প্রথম বার কাঁদতে দেখি আমি সেইদিন। এর আগেও ও কত মার খেয়েছে কিন্তু এত কষ্ট পায়নি কোনদিন। তবে কি বুঝতে পেরেছিল সেই সময় এসে গেছে। এসে গেছে বিচারের ভয়ঙ্কর মুহূর্তটা... উইলি আঙুল তুলে বলে গেছিল যে এর ফল আমাদের ভুগতে হবে। কিন্তু কি সেই ফল?
ইতিমধ্যে মাস চারেক কেটে গেছিল। আর ঐ ভয়ানক দুঃস্বপ্নটা যতটা লেনিকে তাড়া করে ফিরছিল, আমায় করেনি। করেনি কারন আমার আর আমার সন্তানের গায়ে তার সামান্য আঁচড়টাও লাগতে দেয়নি ও। হ্যাঁ, আমার সন্তান, আমাদের ভালবাসার সন্তান, আমার গর্ভে। বনের সেই একটা সপ্তাহেই তো ঘটে গিয়েছিল আশু পরিনতির ঘোষিত সংসর্গ। প্রথমে আমরা কেউই বুঝতে পারিনি। যদিও আমাদের সমাজে আমরা নাবালক ছিলাম না। কিন্তু সত্যি বুঝতে পারিনি কি থেকে কি হয়ে গেল! সেই মুহূর্তে যে কেউ ছিল না বুঝিয়ে দেবার মত। কিন্তু আমাদের মত অনভিজ্ঞ ছিলনা বুড়ি। সে ঠিক বুঝেছিল, আর সেই আমায় জানিয়েছিল। সত্যি বলতে কি আমার লজ্জা হওয়ার থেকেও বেশি হয়েছিল উত্তেজনা। ভীষণ খুশিতে ছটফট করেছিলাম, অপেক্ষা করেছিলাম লেনি কখন ফিরে আসে তার জন্য। শেষে জানিয়েছিলাম যখন, দেখি লেনি নিজেই লজ্জা পেয়ে গেল। দম বন্ধ করে অপেক্ষা করছিল লেনি নিজের রক্তমাংসের বীজের চারাটাকে দেখার জন্য ছটফট করতো কখন শিশুটাকে নিজের বুকে তুলে নেবে আমায় মাটিতে পা ফেলতে দিত না। এত যত্ন, এত আদর আমি আমার ম্যানর হাউসেও পাইনি। আমরা দিন গুনছিলাম। সেই অপার্থিব ঘটনাটা চাক্ষুষ করার অপেক্ষায় ঘুম আসতো না রাতে। লেনিকে দেখতাম খুব পরিশ্রম করতো যাতে আমরা ভাল থাকতে পারি। কিন্ত... পারলাম না। পারতে দিল না। ঐ বিশ্রী লোকটা চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণার দিনটা তরান্বিত করে দিল। অথবা ঐ লোকটাই হয়ত সমস্ত শেষের মূল।
অযাচিত ভাবে এসে গেল সময়টা। গ্রামের মানুষেরা কাজ সেরে যে পথে ফেরে, সেই পথে লুকিয়ে ছিল বিভীষিকা উইলির হাত ধরেদিনের কাজ শেষ করে লেনিও ফিরছিল দুপুর বেলা বাকিদের সাথে। হালকা ঠাট্টা ইয়ার্কি ফাঁকেও নিশ্চয়ই ওর মন পড়েছিল আমার কাছে। কারন প্রতিদিন ফিরেই ও এসে আমায় জড়িয়ে ধরত, মনে মনে কথা বলত চার মাস গর্ভে থাকা শিশুটার সাথে। আর ঠিক গ্রামের মুখটায় আসা মাত্র...
শুনেছি খারাপ খবর হাওয়ার আগে এসে পৌঁছায়। আমার কাছেও এসে পৌঁছেছিল। দিগ্বিদিক ভুলে যখন পৌঁছলাম ওর কাছে, তখন নাটকের শেষ অঙ্কের শেষ দৃশ্য মঞ্চস্থ হচ্ছে। চারিদিকে উপচে পড়া ভিড়, গাঁয়ের ভিতু মানুষগুলো যেন অভিনয় দেখছে স্থাণুর মত। মধ্যিখানে ঘোড়ায় চড়া সৈন্যরা ঘিরে রেখেছে আমার লেনিকে। আর লেনি? রক্তাক্ত, বীভৎস, ছিন্ন বিচ্ছিন্ন শরীরটা নিয়ে ধুলোয় পড়ে কাতরাচ্ছে। লোকগুলোর হাতে খাপখোলা তলোয়ার, আর প্রত্যেকটাকে রক্ত লেগে। তার মানে? ওরা কি সবাই ছেলেটাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছে? জানি না, আমি কিচ্ছু জানি না। ভালো ভাবে মনেও পড়ছে না। আমি তো ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম লেনির উপর। তারপর? অনেক বছর আগেও এই ভাবেই না মার খেত লেনি অন্যদের কাছে মুখ বুজে শুধু আমার জন্য? আর আজও। আজও সে পড়ে আছে, মুখ বুজে, আর এবারেও আমার জন্য! কিন্তু সেবারের মত সে আমায় ডেকে উঠবে না এলিন বলে? আজও যে তার ছোট্ট আশীর্বাদ তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
লেনির শেষ শব্দটা কি ছিল? না ছিল না। লেনি কোন কথা বলেনি মুখ দিয়ে। আমি পাগলের মত সাহায্য চাইছিলাম, কেউ এগিয়েও আসেনি। আসবেই বা কেন? কি দায় পড়েছে ওদের? কেই বা যেচে তার পরিবারকে ঐ পিশাচগুলোর হাতে তুলে দেবে? রাতের অন্ধকারে গোটা গ্রামটাকে যে ওরা জ্বালিয়ে দিতে পারে। শুধু বৃদ্ধ গ্যাব্রিয়েল একা কি পারে ওদের সাথে? লোকগুলো যে ওকে আটকে রেখেছিল। না জানি বেয়াক্কেলে বুড়োটার জন্য ওদের চরম সর্বনাশ না হয়ে বসে। নাহ ওদের কথা না, লেনির কথা বলছিলাম। ঠিকই বলেছি। লেনি মুখ ফুটে একটা কথাও বলেনি। কিন্তু আমি শুনতে পেয়েছিলাম। নিভে যাবার আগে ওর চোখ দুটো অনেক কিছু বলে গিয়েছিল শেষ মুহূর্তে। ওর মৃত্যুর সময় জল দেবার মত কেউ ছিলনা। আমার অজান্তেই আমার ঠোঁট দুটো নেমে এসেছিল ওর ঠোঁটের ওপরআকণ্ঠ পান করেছিলাম শেষ বারের মত আমরা নিজেদের।
কি ভাগ্য আমার! যে লেনি আমায় ছোট্ট আশীর্বাদ বলে ডাকতো, আজ তার জীবনের সবচেয়ে বড় অভিশাপটা নেমে এলো আমারই জন্য। লেনির ঠোঁটটা ছোঁয়ার পর আমার কোন চেতনা ছিল না। তাই কখন কিভাবে কোথা দিয়ে কোথায় পৌঁছে গেলাম জানি না। চোখ মেলে দেখি আমি আমার ঘরে শুয়ে আছি। মানে? আমি কি স্বপ্ন দেখছিলাম? কিন্তু এত দুর্বল লাগছে কেন নিজেকে? একটু ওঠার চেষ্টা করতেই দেখি কেউ দৌড়ে এলো আমার কাছে। বিয়াত্রিচে!
না, কোন ভুল দেখিনি আমি, সে বিয়াত্রিচেই। সব জেনেছিলাম এক এক করে। কিভাবে একটা গ্রামের লোক (উইলি) দেখা করেছিল এই কাসেলে এসে, কিরকম তৎপরতায় সৈন্য সাজিয়ে রওনা দিয়েছিল ওরা, আর কিভাবে দিন চারেক বাদে অচৈতন্য আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছিল। কিন্তু এ সবের পিছনে কে ছিল? বিয়াত্রিচে আমার অন্যতম বন্ধুটির নাম নিল। এডওয়ার্ড। তবে কি বাবাও এ সবের মধ্যে ছিল? না, সেটা ঠিক নয়। বরং একটু অন্য ঘটনা ঘটেছিল। আমার নিরুদ্দেশ হওয়ার পর, বাবা এডওয়ার্ড কে সব দিয়ে নিজেই নাকি নিরুদ্দেশ হয়ে যান। আমার বিশ্বাস হয়নি এ কথাটা। আমি নিঃসন্দেহ ছিলাম, এটা এডওয়ার্ড এরই মিথ্যে রটনা। বিয়াত্রিচেকে এনে রেখেছিল, কারন ওকে অবিশ্বাস করার মত তখনও কিছু পায়নি বলে। এডওয়ার্ড নিশ্চয়ই জানত না যে আমাদের পালানোর পথ দেখিয়েছিল বিয়াত্রিচেই।
সেই ঘটনার পর আরও মাস ছয়েক কেটে গেছিল। বা বলা ভাল, আমি কাটিয়েছিলাম। আমার লেনির দুটো স্মৃতি চিহ্ন ছিল আমার কাছে। এক, সেই ঘোড়াটা। বিয়াত্রিচে সেটাকে যত্ন করে রেখে দিয়েছিল। আর দুই, আমার গর্ভের শিশুটা যাকে আমি সযত্নে লালন করছিলাম একটা নির্দিষ্ট দিনের জন্য যেদিন লেনি তার চোখ দিয়ে আবার পৃথিবীর আলো দেখবে। আমি যতটা পারা যায় নিজের মধ্যে দিয়ে আমার ছোট্ট লেনির যত্ন নিতাম। স্বপ্ন দেখতাম লেনিকে দুহাতে আবার জড়িয়ে ধরার। আর সে কথা ভাবলেই একটা শিরশিরে ঠাণ্ডা কিছু বয়ে যেত ভেতরে। আমি আর বিয়াত্রিচে কত গল্প করতাম, তার পুরোটাই ভরা থাকতো অতীত আর আগামীর লেনি কে নিয়ে। কিন্তু আবার একটা খারাপ খবর নিয়ে এলো বিয়াত্রিচে। এডওয়ার্ড নাকি আমায় বিয়ে করতে চায়। আমি চুপচাপ ছিলাম সব শুনেও। ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল যখন এড নিজে আমার কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এলো। সশব্দে একটা চড় মেরেছিলাম ওকে। আর সেটার জবাবে ও ঘুরে দাঁড়িয়ে একপলক আমার দিকে তাকিয়ে অন্য দিকে ফিরল। সে দৃষ্টিতে ছিল অপরিসীম রাগ আর ঘৃণা, সে তাকিয়েছিল আমার সদ্যপ্রসূত সন্তানটির দিকে। আমি কেঁপে উঠেছিলাম।
এডওয়ার্ড কত দূর নীচে নামতে পারে আমি দেখেছিলাম। লেনিকে প্রাণভিক্ষা করার সুযোগটুকুও দেয়নি। কিন্তু আমাদের সমাজে এই হত্যাগুলো সামাজিক মর্যাদা বাড়িয়ে তোলে বই কমায় না। এরা লেনিদের মানুষ বলে মনে করে না। এরা লেনির চিহ্ন মুছে দিতে দুবার ভাববে না। ভীষণ অসহায় লাগছিল নিজেকে। টানা দুদিন কিভাবে কাটিয়েছি জানিনা। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসতো, কিন্তু টানটান হয়ে বসে থাকতাম লেনিকে পাহারা দিতে। আমার ছোট্ট সোনাটাকে আমি লেনি বলেই ডাকতাম। চেয়েছিলাম লেনির রক্ত লেনির নাম নিয়েই বাঁচুক। কিন্তু আর কতদিন ওভাবে কাটাব! আমি যে এখানে নজরবন্দি। সাতদিনের বাচ্চাটাকে বুক দিয়ে আগলে রাখতাম, যেভাবে একদিন লেনি আমায় আগলে রেখেছিল। কাউকে বিশ্বাস করতাম না শুধু বিয়াত্রিচেকে ছাড়া। তাই সেদিন রাতের অন্ধকারে কেঁদে পড়েছিলাম ওর কাছে। লেনিকে তুলে দিয়েছিলাম ওর হাতে। আমি জানতাম এড যেকোনো দিন ছিনিয়ে নিতে আসবে আমার কাছ থেকে। অনুরোধ করেছিলাম লেনিকে নিয়ে পালিয়ে যেতে অনেক দূরে। কোনরকম প্রস্তুতি ছাড়াই, কারন আমার মন বলছিল এড চারিদিকে চর ছড়িয়ে রেখেছে। সেই রাতেই বেড়িয়ে পড়েছিল বিয়াত্রিচে আমার লেনিকে নিয়ে।
এর পরের ঘটনা খুব সীমিত। একদিন পর এডওয়ার্ড এসেছিল আমার ঘরে। ওর নাকি আমায় দুটো উপহার দেবার আছে। একটা সে আমায় নিজে দেখাতে চায়, অন্যটা আমি নাকি নিজে থেকে দেখতে চাইব। অদ্ভুত হেঁয়ালি! ওর বক্তব্য ঐ উপহারগুলো পাবার পর আমি নিজেই ওকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যাব। কোনক্রমে রাগ চেপে রেখেছিলাম আমি, কারন আমার মন বলছিল বিয়াত্রিচে লেনিকে নিয়ে যতদূর যেতে পারে চলে যাক, আমি এই বিকৃত লোকটাকে আটকে রাখি। হিসাবে ভুল ছিল, আর ধরা পড়লো যখন এড তার প্রথম উপহারটা আমার দিকে এগিয়ে দিল। একটা রেকাবিতে লাল রেশমের কাপড় ঢাকা টাটকা গোলাপ। হ্যাঁ, টাটকাই বটে। বিয়াত্রিচের সদ্য কাটা মাথাটা লাল গোলাপের চেয়েও মারাত্মক রকমের লাল!!
দ্বিতীয়টা পেতে আমায় যেতে হয়েছিল, নীচের একটা পাথরের ঘরে, এই ঘরটার সামনেটায় তারের জাল দিয়ে আটকানো, যাতে বাইরে থেকে ভিতরের সব কিছু পরিষ্কার দেখা যায়। আমিও দেখেছিলাম। আমার ছোট্ট লেনির দেহটা নিয়ে একটা পিশাচকে খেলা করতে। আমায় আটকে রেখে এক এক করে দেখানো হচ্ছিল, কিভাবে একটু একটু করে একটা প্রাণ নিয়ে খেলা করা যায়। কখনো একটা হাত ধরে ঝুলিয়ে, কখনও পাদুটো ধরে মাথাটাকে পাথরে ঠুকে বা... আমার সাত দিনের লেনিরও তার বাবার মত একটা রক্তাক্ত মাংসপিণ্ড ছাড়া আর কিছু ছিল না।
কেউ কোনদিন জানতে চায়নি আমি কি চেয়েছিলাম, আমি কি চাই। তাই এরপর আমি কি করবো তার কৈফিয়ত আমি কাউকে দিইনি। একের পর এক মৃত্যু আমার কান্না থামিয়ে দিয়েছিল। আমি বিনা বাক্যব্যায়ে নিজের ঘরে ফিরে এসেছিলাম। পরের দিন সকালে এডওয়ার্ড আমার জন্য নতুন একটা বিয়ের গাউন পাঠিয়েছিল। আমি পরেছিলাম। সাদা রঙের। যে মেয়েটা আমার দেখভাল এর দায়িত্বে ছিল, সে এসে খবর দিল এডওয়ার্ড আমার ঘরে আসার জন্য অপেক্ষা করছে। তাকে ভিতরে আসার অনুমতি দিয়ে আমি আস্তে আস্তে আমার প্রিয় জানলাটার দিকে এগিয়ে যাই আমি। আমার হাতে ধরা ছিল লেনির দেওয়া ঘোড়াটা। এডওয়ার্ড এসে ঘরে ঢোকে। হয়ত এগিয়েও এসেছিল কয়েক পা। আমি একবার পিছন ঘুরে তাকিয়েছিলাম তার দিকে। তারপর যে পথে একদিন লেনি আমায় নিয়ে পাড়ি দিয়েছিল, সেই পথে আমি চিরদিনের জন্য পালিয়ে গেলাম। আমার শরীরটা আছড়ে পড়েছিল জানলা গলে।

প্রোফেসর নাশৎ এভাবে আমার বন্ধুর অতীত টেনে এনেছিলেন। ক্লান্ত ব্লেজ আমার কাঁধে ভর দিয়ে ফিরে এসেছিল তার বাড়িতে। মাঝে মাঝে রুথ অ্যান্টি ওকে চেকআপ এর জন্য প্রোফেসর এর চেম্বার এ নিয়ে যেতেন। ক্রমে ব্লেজ আবার পুরনো দিনগুলোতে মানিয়ে নিচ্ছিল। ইতিমধ্যে আমার ফাইনাল পরীক্ষা এসে যায়। খুব ব্যাস্ততার মধ্যে কাটে দিনগুলো। তারপর ওনাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ভারতে ফিরে আসি আমি।

এক বছর পরে...
আমি কোন একটা কাজে বেরব বলে ব্যাগ গোছাচ্ছিলাম। একটা এনভেলপ এলো আমার নামে। তাড়ায় ছিলাম, এনভেলপটা খোলার সময় হয়নি তখন। ফিরতে বেশ রাত হয়েছিল। সারাদিনের খাটাখাটনিতে ভুলেই গেছিলাম সকালের পার্সেলটার কথা। মনে পড়লো খাবার টেবিল এ বসে। রুথ অ্যান্টি লিখেছেন চিঠিটা। খুব সাধারন ভাষায় লেখা একটা চিঠি। কুশল বিনিময়, সবার খবর নেওয়া আর আমার ওপর অভিযোগ, আমি অনেকদিন সত্যিই যোগাযোগ করে উঠতে পারিনি। আর শেষে ব্লেজ এর মৃত্যুসংবাদ। আমার বুকটা ছ্যাত করে উঠেছিল, অ্যান্টি কি পাগল হয়ে গেছেন? নিজের সন্তানের মৃত্যুটাকে এত স্বাভাবিক ভাবে কি করে নিতে পারে একটা মানুষ? আর ব্লেজ!! ও কিভাবে আত্মহত্যা করতে পারল? ও তো স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল প্রায়... এর উত্তর আমার জানা ছিল, আজ বুঝলাম। শেষ দিন যেদিন আমি ফিরে আসছি, আমায় বিদায় জানাতে এসে ব্লেজ একটাই কথা বলেছিল, “ছোট্ট আশীর্বাদ কোনদিন একা থাকবে না, লেনি তাকে নিতে আসবেই” আর রুথ অ্যান্টিও তাঁর চিঠিতে তাই লিখেছিলেন। ‘...আমার মেয়েটা যতটা না আমার ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল সেই স্কোয়ারের। ওর ভালবাসা ওকে নিয়ে যেতে এসেছিল, আমি বাধা দিইনি। তোমায় অনেক ধন্যবাদ আমার মেয়েটাকে সাহায্য করার জন্য। আমি আশা করি ছোট্ট আশীর্বাদ তার লেনির কাছে শান্তি পেয়েছে। ভালবাসা নিও, রুথ’...







Download and install Avro Keyboard to view the contents.
Mail us to phoenix.punoruday11@gmail.com for pdf version of this Magazine.

No comments:

Post a Comment