Saturday, 14 April 2012

Jontrona by Bijan Pramanik


যন্ত্রণার জারিজুরি
বিজন প্রামাণিক


মাস দুয়েক আগে আমার দুটো বড় বড় অপারেশন হয়েছিল। অপারেশন জনিত কারণে শারীরিক যন্ত্রণায় আমি যখন একেবারে কাবু, রাতে চুপচাপ চোখ বুজিয়ে শুয়ে আছি। যন্ত্রণায় দু-চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। হঠাৎ সেসময় একটা কোমল হাত আমার মাথায় স্পর্শ করল। আমি একটু চমকে উঠলুম। মা তো পাশের ঘরে ঘুমাচ্ছে, তাহলে কে, কার হাত!! আমি চোখ খুললুম। একি! আমি ভুল দেখছি নাতো? এতো সেই চাঁদের সুতো কাটা বুড়িমা, যার গল্প আমার ঠাকুমা ছোটবেলায় শোনাতেন সেই বড়িমা আমার পাশে বসে মাথায় হাত বুলাচ্ছে। আমি বললুম-
“বুড়িমা তুমি কখন এলে? তুমি কি করে জানলে আমার শরীর খারাপ?”
বুড়িমা আমার ডান চোখের জল মুছে দিতে দিতে বললে-“ওরে পাগল ছেলে, আপনজনের কি আর বলতে লাগে রে, তাঁরা ঠিক বোঝে আপনজনের ব্যাথা। তাই তো আমি থাকতে না পেরে চলে এলুম রে এই যে তুই নিজেকে এতো একা একা ভাবতিস্‌, কিন্তু দেখলি তো তোর কত আপনজন রয়েছে”
-“সত্যি! আমি কি বোকা”।
বুড়িমা মৃদু হেসে বললে-“তা একটু আছিস্‌ বটে। তবে বোকার থেকে পাগলামি-টাই বেশী তোর।  আসলে জানিস তো আপনজনেরা সামনে না আসলেও দূর থেকেও তাঁরা মঙ্গলকামনা করে যায়”।
-“ঠিক বলেছো বুড়িমা”। বুড়িমা সাথে কথার মাঝে আমি যন্ত্রণায় কাতরে উঠলুম”।
-“কিরে খুব বেদ্‌না হচ্ছে? একটু সহ্য কর, কষ্ট না করলে কেষ্ট মেলে না রে”।
-“তা বলে এতো যন্ত্রণা”।
-‘ওরে পাগল তোর এই বেদ্‌না তো কিছুই নয় রে। এই দুনিয়াতে কত লোকের যে কত রকমের বেদ্‌না তা আমি উপর থেকে সব দেখতে পায় রে”।
-‘কত রকমের বুড়িমা?’
-‘সে কি আর এক-দুরকমের যে মনে থাকবে। এই ধর কারোর বেদ্‌না শিন্‌শিন্‌, কারোর আবার চিন্‌চিন্‌, কারোর টন্‌টন্‌, কারোর আবার ঝন্‌ঝন্‌, কন্‌কন্‌”।
-‘কিন্তু বুড়িমা আমার যে মনে হয় যন্ত্রণায় শরীর ফেটে যাচ্ছে’।
-‘শরিলের বেদ্‌না তো, কষ্ট টা বেশী। এই বেদ্‌না হল ছ্যাঁচড়া বেদ্‌না, তোদের এই পীথিবীর সন্ত্রাসবাদ হামলার মতো। নিজেও মরে আর অপরকেও মারে। এর বিভৎস্য রূপ মরণ ছাড়া আর কিছু চায় না। এ রক্ত মাংসের জীবকে খোঁচা খাওয়া বাঘের মতো করে তোলে হিংস্র’
-‘তাই জন্য মা বলে আমি রাগী হয়ে গেছি আগের থেকে। আচ্ছা বুড়িমা আর কি রকমের যন্ত্রণা আছে?’
‘মনের বেদ্‌না হল আর এক রকমের বেদ্‌না। তোরা যাকে বলিস্‌ মানসিক যন্ত্রণা। এই বেদ্‌না অনেকটা কাঠে ঘুণ ধরার মতো, ভিত্‌রে ভিত্‌রে কখন যে ফোক্‌লা হয়ে যায় বাইরে থেকে বোঝা দায়। এই বেদ্‌না কমবেশী প্রায় সব মানুষের থাকে। তবে সন্তানের কোনো কষ্টতে মায়ের মনের বেদ্‌না সবচেয়ে বেশী। আবার সন্তান যখন সেই মাকে কষ্ট দেয় সে মায়ের মনের কষ্ট আরো বেদনাদায়ক’।
-‘ঠিক বলেছো বুড়িমা। এই দুনিয়াতে কত লোক কতশত যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছে’।
-‘তবে কি জানিস্‌ বিজু, এই সব বেদ্‌নার মাঝে একটা অন্যরকম বেদ্‌নাও আছে’।
-‘কী সেটা?’
-‘হৃদয় বেদ্‌না হল অন্য এক রকমের বেদ্‌না’।
-হৃদয় বেদ্‌না??
-‘হ্যাঁ রে, হৃদয় বেদ্‌না যারে তোরা ভালবাসার বেদ্‌না বলিস্‌।
-‘ওওওও... তাই বলো’।
-‘জানিস তাহলে, মনে হচ্ছে তুই এই বেদ্‌না পেয়েছিস্‌’?
-‘ধুসসস্‌... কি যে বলো বুড়িমা। এই সব থেকে আমি বিশ হাত দূরে থাকি’।
-‘দেখিস্‌ আবার বেশী দূরে চলে যাস্‌নি। তাইলে, আনা মুশকিল’।
-‘বাজে বকোনা বুড়িমা’।
-‘আচ্ছা বাবা ঠিক আছে... এই হৃদয় বেদ্‌না অনেকটা টক-ঝাল-মিষ্টি মতো বুঝলি। এটা বড্ড অভিমানীও বটে।
-‘তাই’
-‘হ্যাঁ রে, যার জন্যি এই বেদ্‌নার উদয় তাকে কোনো ভাবেই দোষারূপ করা যায় না, বরং নিজের দোষটাই বেশী মনে হয়। এই বেদনা অনেকটা স্বেচ্ছাচারীও, এর জন্যি কখন যে কি করে বসে মানুষজন বলা মুশকিল। একে বাইরে থেকে দেখা যায় না ঠিকই, কিন্তু এর রূপও ভয়ংকর। এই বেদ্‌নায় যেন শরিল, মন দুটোই কষ্ট পায়। এই বেদ্‌নায় কিছুতেই ধীর থাকা যায় না।
এছাড়াও একটা বেদ্‌না আছে, তাতে দূঃখ কষ্টের থেকে আনন্দটাই বেশী.........’
হঠাৎ একটা গাড়ীর ভোঁপুর আওয়াজে আমার ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। চোখ খুলতেই দেখি সকাল হয়ে গেছে, জানালা দিয়ে গ্রীষ্মের তীব্র আলোর আভা ঘরে প্রবেশ করছে। চোখে হাত রাখতেই অবাক হয়ে গেলুম। দেখি! আমার ডান চোখটা শুখনো কিন্তু বাম চোখের জলের ধারা কানের পাশ দিয়ে নেমে গেছে। তবে কি সত্যিই বুড়িমা......... !!!!!

সমাপ্ত


(এখানে বুড়িমার গ্রাম্য ভাষাই দেওয়া আছে, উচ্চারন অনুযায়ী)





Download and install Avro Keyboard to view the contents.
Mail us to phoenix.punoruday11@gmail.com for pdf version of this Magazine

No comments:

Post a Comment