Saturday, 14 April 2012

Probondho: Gitanjali o Astitwabad by Joydip Ghosh


“গীতাঞ্জলি” ও অস্তিত্ববাদ

জয়দীপ ঘোষ



শুনতে পাই আমাদের এই বাংলায় কবির সংখ্যা যত বাড়ছে, কবিতার পাঠকের সংখ্যা ততই কমে যাচ্ছে। কথাটার সত্যি মিথ্যা জানি না, তবে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি কবিতার পাঠকের সংখ্যা সব দেশে সব কালেই কম। আর এও বিশ্বাস করি যে, সেই কতিপয় কবিতা পাঠকের হৃদয়ে যে কবির নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে তিনি আমাদের প্রাণের ঠাকুর, মনের ঠাকুর – রবি ঠাকুর। বিগত বছরে আমরা আমাদের হৃদয়ের অর্ঘ্য অর্পণ করেছি তাঁর সার্ধশত জন্মবর্ষে, আর আগামী বছর পালন করব কবিগুরুর নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির শতবর্ষ।

যে কাব্যগ্রন্থের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন তা এক অস্পষ্ট “আমি”-র দীর্ঘ কবিতাগুচ্ছ, নাম – “গীতাঞ্জলি”। সমগ্র গীতাঞ্জলির এই “আমি” ঘটিত কবিতাগুলির মধ্যে এক অনির্দিষ্ট “তুমি”-ও সর্বদা বর্তমান। কবিতার মধ্যে যে “আমি” ও “তুমি” কে আমরা পাই তারা দুটি পৃথক ব্যক্তি, নাকি একই ব্যক্তির দুটির পৃথক সত্তা?

গীতাঞ্জলির প্রথম কবিতায় আমরা দেখি “আমি” এবং “তুমি” পরস্পরের মুখোমুখি। “তুমি”-র কাছে আত্মসমর্পণ করতে “আমি” এখানে অধীর। কাব্যিক মেটাফরকে যদি আমরা আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ না করি তাহলে দেখব যে কোন মধ্যম পুরুষ বা ঈশ্বর তো নয়ই, এমনকি কোন দ্বিতীয় ব্যক্তির উপস্থিতিও এখানে নেই – “তুমি” চিরন্তন হয়ে রয়ে গেছে “আমি”-র মধ্যে। “আমি” আর “তুমি” পরস্পর চিরসম্পৃক্ত, ভিন্ন হয়েও অভিন্ন। গীতাঞ্জলির ১২০ সংখ্যক কবিতায় কবি এই চিরন্তন “তুমি”-কেই “সীমার মাঝে অসীম” বলে সম্বোধন করেছেন। “তুমি”, “আমি”-র ওপর “আপন সুর” বাজায়, নিজেকে বিস্তার করে, তাইতো “আমি”-র মধ্যে “তুমি”-র প্রকাশ এত মধুর।

গীতাঞ্জলি কাব্যে “তুমি” কোন প্রেমিক বা প্রেমিকা নয়, কোন ব্যক্তি বা ঈশ্বরও নয়, সে “আমি”-র মধ্যে অবস্থিত আরেক “আমি”। “তুমি”-র প্রতি “আমি”-র ব্যাকুলতাকে রবীন্দ্রনাথ মধ্যযুগীয় বৈষ্ণব কবিতার আদলে, প্রেম-বিরহের মেটাফরে সাজিয়েছেন। তবে এই “তুমি” বাইরের কোন ব্যক্তি নয়, সে “আমি”-র মধ্যে নিমজ্জিত এক সত্তা।

গীতাঞ্জলির প্রারম্ভিক কবিতায় কবি চেয়েছেন তাঁর সেই অহংবোধকে চূর্ণ করতে, যে মিথ্যা অহংবোধের আবরণে রুদ্ধ হয়ে থাকে কবির প্রকৃত সত্তা। অর্থাৎ এখানে কবির প্রকৃত সত্তা হল “তুমি”। কবি তাঁর মিথ্যা “আমি”-কে নত করতে চান, আর চান সত্য “আমি” বা “তুমি”-র প্রতিষ্ঠা। তাইতো তিনি বলেন – “আমারে আড়াল করিয়া দাঁড়াও তোমার চরণতলে”।

গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ১৬ সংখ্যক কবিতায় আমরা দেখি যে কবি বিরহী প্রেমিকের মেটাফর ব্যবহার করেছেন – “মেঘের পরে মেঘ জমেছে,/ আঁধার করে আসে,/আমায় কেন বসিয়ে রাখ/ একা দ্বারের পাশে”। কবি এখানে তাঁর সত্য “আমি”-র প্রেমে আবিষ্ট। তিনি যেন নিজেরই প্রেমিক, তাঁর নিজের “আমি” যেন নিজের ভেতরেই অবস্থিত “তুমি”-র অন্বেষণে ব্যাপৃত। এখানে “আমি” অপর “আমি”-র জন্য অপেক্ষমান। তাই সেই “আমি” অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং তাঁর আপন গৃহদ্বারেই বসে আছেন। গৃহটি অবশ্য  মনের ভিতরের গৃহ। আসলে সব মানুষই নিজের নিজের গৃহদ্বারে বসে আছে, বসে আছে নিজের অবিদ্যামুক্ত সত্তার সাক্ষাতের আশায়।

রবীন্দ্রনাথের অস্তিত্ববাদের এক অনবদ্য দলিল “গীতাঞ্জলি”। রবীন্দ্র অনুভূত অস্তিত্বদর্শন এখানে শব্দময় ও ক্রিয়াময় রূপ ধারণ করেছে। “গীতাঞ্জলি” কাব্যগ্রন্থে “বিরহ” শূন্যতা বা বিচ্ছিন্নতাবোধেরই অপর নাম। এখানে শূন্যতা অস্তিত্ব বহির্ভূত ব্যাপার নয়, বরং তা অস্তিত্বের সঙ্গে একেবারে সম্পৃক্ত। তাই “গীতাঞ্জলি” কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি পাঠক-পাঠিকার কাছে শুধুমাত্র পূজা ও প্রেম পর্যায়ের কবিতা না হয়ে, হয়ে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের অস্তিত্ববাদী দর্শনের এক অনবদ্য নিদর্শন।





Download and install Avro Keyboard to view the contents.

Mail us to phoenix.punoruday11@gmail.com for pdf version of this Magazine.


No comments:

Post a Comment