~: পিরামিড :~
পিয়ালী দাস
প্রথম অংশ
বাড়িতে সবে কম্পিউটার কেনা হয়েছে। সঙ্গে কালার প্রিন্টার। এক্কেবারে নিজের একটা কম্পিউটার!! বন্ধুদের মধ্যে তখনো কারো ছিলোনা এমন, তাই একটু কারিকুরি করার ইচ্ছে হয়েছিল। পড়াশুনা আপাতত বন্ধ। কিছুক্ষন বাদে মায়ের জোরালো ডাক, “কিরে, করছিস কি দরজা বন্ধ করে?” ‘পেন্ট’এ গিয়ে কাঁচা হাতে আঁকছিলাম ত্রিভুজ। রঙিন, ঝিলিমিলি তারা আঁকা চারটে ত্রিভুজ। প্রিন্ট করে নিলাম ত্রিভুজগুলো। কায়দা করে জুড়েও দেওয়া গেল। দেখে বোনের কমেন্ট “ইটজ্ আ বিউটিফুল পিরামিড...”। পিরামিডটার মাথায় লাগিয়ে দিলাম হাতে বানানো রঙিন সুতোর বেনুনি। এবার সুতোটা ধরে ঝুলিয়ে দিলেই হল দরজা বা জানালায়। হাওয়া লেগে ঘুরবে ক্রমাগত।
১০ই সেপ্টেম্বর
আজ সৌজন্যা-র জন্মদিন। দেড় ঘণ্টা বাস আর মেট্রো চড়ে কলেজে পৌছালাম। খুব সাবধানে ভিড়, গুঁতোগুঁতি বাঁচিয়ে এনেছি আজ পিরামিডটাকে। কিন্তু বার্থ-ডে গার্ল কই? নাহ, সে আজ আসেনি। জন্মদিন সেলিব্রেট করতে গেছে তার বিশেষ বন্ধুর সাথে। অগত্যা পিরামিড ফিরে এলো বাড়িতে।
১১ই সেপ্টেম্বর
আজ এসেছে সৌজন্যা। কিন্তু ভুলো মন আমার ভুলেছে তার গিফট টা আনতে।
১২ই সেপ্টেম্বর
কাল দুই-তিন বার ফোনে কনফার্ম করে তবে কলেজে এনেছি পিরামিডটা আজ সৌজন্যা আসবেই বলেছে।
ফার্স্ট ইয়ারে নতুন বন্ধুকে নতুন কিছু দেওয়ার আনন্দে সময়ের একটু আগেই পৌঁছে গেছিলাম কলেজে। গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। হটাৎ দেখলাম স্কুলের বন্ধু রিধিমা বেরোচ্ছে কলেজ থেকে। সে আমাদের কলেজের মর্নিং সেশনে পড়ে। অনেক দিন পর দেখা বাচ্চাবেলার বন্ধুর সাথে। অনেক হাসি আর টুকটাক কথার পর রিধিমা-
---“এটা কি রে? কারোর জন্যে বানিয়েছিস এবার?”
---হ্যাঁ।
স্কুলের অনেক বন্ধুই জানত আমার এই শখের কথা। বন্ধুদের জন্মদিনে নিজের হাতে বানানো উপহার দেওয়ার শখ ছিল আমার। উপহারটা দেখে ঈষৎ গম্ভীর হয়ে বলল,
---“তুই জানিস না পিরামিড কিসের প্রতীক?”, ঘাড় নাড়লাম। জানি না। কিন্তু কেমন করে উঠল মনটা।
---“মৃত্যুর”
জোর করে হটাৎ হেসে অসস্তি কাটাতে চাইলাম।
---“কি যে বলিস!!” ও আবার (কু)সংস্কারের ভক্ত।
---“আমি সিরিয়াসলি বললাম” পিরামিডটাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে বলল রিধিমা, “আর তুই এটা গিফট করছিস কারোর জন্মদিনে!”
আমি তখনো প্রাণপণে ভাবার চেষ্টা করছি, এখুনি রিধিমা হেঁসে উঠে বলবে কেমন ঘাবড়ে দিয়েছি তোকে? কিন্তু ও বলল না নিরবতা ভাঙ্গলাম আমিই।
---“তাহলে কি দেবো না... গিফট টা?”
---“তা বলছিনা আমি। তুই এত ভালবেসে বানিয়েছিস। নিশ্চয়ই দিবি, (একটু থেমে) তবে পারলে আর কখনো কাউকে পিরামিড গিফট দিস না।”
রিধিমা তো বলে চলে গেল। দিয়ে গেল জন্মের অসস্তি। দেবো কি দেবনা? উচিত হবে কি হবে না? উফ কেন ভাবছি এত। ওই তো বলল, এত শুভেচ্ছা নিয়ে বানানো জিনিসটা কি অশুভ হতে পারে?
দ্বিতীয় অংশ
সৌজন্যা কিন্তু খুব খুশী হয়েছিলো পিরামিডটা পেয়ে। একে একে যারা ক্লাসে এসেছে, সবাইকে নিজেই ডেকে গিফটটা দেখিয়েছিল। ওর আনন্দে ঢাকা পড়ে গেছিল আমার ভয়, আমার অস্বস্তি। কেউ ওর কথা ভেবে নিজের হাতে কিছু বানিয়েছে, যেন এটাই ওকে অবাক করেছিল সবচেয়ে বেশী। খুশী ছিল ও... আমিও।
ক্লাসে মেয়েদের মধ্যে মাত্র দুজনেরই মোবাইল ছিল তখন। নিশা আর আমার রোজ নিয়ম করে এস এম এস-এ লেখা কবিতা নিয়ে আলোচনা চলত আমাদের। সেদিন স্যারের ক্লাসে নিশা আর আমি বসেছিলাম ফার্স্ট বেঞ্চে। খাতার পাশে রাখা ছিল নিশার মোবাইল। বড় একটা রুমালে ঢাকা। স্যার ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে ঘুরলেই চলছিলো এস এম এস পড়ার ক্লাস। হটাত কেঁপে উঠল মোবাইলটা। সৌজন্যার বাড়ি থেকে ফোন আসছে।
সৌজন্যা বসেছিল ফোর্থ বেঞ্চে। আমাদের থেকে বেশ কিছুটা দূরে। প্রথমবার এত ঘাবড়ে গেছিলাম কল টা আসাতে যে স্যার কিছু বুঝেছেন কিনা বোঝার চেষ্টা করতে করতেই ফোনটা কেটে গেলো। তখনো বেশ ভয়ে আছি, আবার ফোন ওর বাড়ি থেকে। একটু অবাক হলাম। নিশার সাথে সৌজন্যার তেমন বন্ধুত্বই নেই যে ওর বাড়ি থেকে আমাকে বাদ দিয়ে নিশাকে ফোন করবে। মনে পড়ল, আমার মোবাইলটা সিটের নিচে, ব্যাগে রয়েছে। নিশা জিজ্ঞেস করল।
---“কি করব? ফোনটা চালান করবো নাকি পেছনে?”
কিছু উত্তর না দিয়ে আমি ব্যাগ থেকে আমার মোবাইলটা বের করে দেখলাম। নাহ। আমাকে তো ফোন-ই করা হয়নি। কেমন একটা লাগলো। অবশ্য, আমাকে কল করলেও শোনা যেত না। হয়তো দরকারি ফোন। একটু অন্যমনস্ক হয়েছি কি আবার প্রশ্ন,
---“ওরে... আবার ফোন আসছে যে।”
---“পিছনে পাঠা। হয়তো কোনও এমারজেন্সি...” বলেই মনটা ছ্যাঁত করে উঠল।
পিছনে ফিরে দেখলাম সবে ফোন টা হাতে পেয়েছে সৌজন্যা। সামান্য ভুরু কুঁচকে এক মুহূর্ত দেখল নাম্বারটা। কলটা কানেক্ট করে কানে ধরল। চোখের সামনে দেখলাম ওর অভিব্যক্তি বদলে যাচ্ছে একটু একটু করে। রুদ্ধশ্বাসে দেখছি, একটু একটু করে বিস্ফারিত হতে লাগলো ওর বড় বড় চোখ দুটো। কান থেকে ফোন নামিয়ে ও রীতিমত কাঁপছে তখন। মায়াচ্ছন্নের মত দেখছি খুব নিছু গলায় আশেপাশের বন্ধুরা কি হল জিজ্ঞেস করছে ওকে। চমক ভাঙল নিশার স্বরে,
---“কি হয়েছে ওর?”, দেখলাম অবাক ভাবে আমাকে দেখছে নিশা।
---“জানি না।”
---“তোর কি হল?” ঢোঁক গিলে বললাম,
---“জানিনা”
শুনলাম পিছনে সৌজন্যা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “বাড়ি যাব”। কাউকে কিছু বলার বা ভাবার সুযোগ না দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে হটাতই স্যারকে জানালাম সৌজন্যার বাড়ি থেকে ফোন এসেছে। ও বাড়ি যেতে চায়। এমারজেন্সি। ঘটনার আকস্মিকতায় স্যার একটু অবাক। দেখলাম সৌজন্যা উঠে দাঁড়িয়েছে। দু-গাল বেয়ে জল গড়াচ্ছে ওর। স্যার ওকে বললেন “তুমি একা যেতে পারবে?”
কিছু উত্তর না দিয়ে বেরিয়ে গেলো সৌজন্যা। আমরা হা করে দেখলাম। আমিও দেখলাম, কি দেখলাম জানিনা। মনের মধ্যে একটা শব্দই ঘুরে ফিরে আস্তে লাগলো, “পিরামিড”।
তৃতীয় অংশ
ক্লাস শেষ হল এক সময়ে। অনেকে বেরিয়ে গেলো ক্লাস থেকে। আমরা মেয়েরা বসে রইলাম। নিশা তখন চেষ্টা করে যাচ্ছে সৌজন্যার বাড়ির ফোন ধরার। ফোন নাকি রিং হয়ে যাচ্ছে। কেউ ধরছে না । সৌজন্যা তো বলেছিল বাড়িতে যাবে। কিন্তু বাড়িতে কেউ না থাকলে...!! সবাই এই নিয়েই কথা বলে যাচ্ছিল। কি হয়েছে? কি হয়েছে? আমি আর পারলাম না বসে থাকতে। মোবাইলে ব্যালেন্স ছিল না। ছুটলাম কলেজের নিচে ফোন বুথে। আমার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে পিছন পিছন ছুটল সিঞ্জিনি।
কলেজের গেটের কাছে পৌঁছাতেই শুনলাম কিসের শোরগোল। গেটের মুখে বেশ কিছুটা ভিড়। বাইরে কিছু ঝামেলা হয়েছে হয়ত। আতঙ্ক চোখে সিঞ্জিনি আর আমি দেখলাম একজনের কাঁধে ভর দিয়ে একটা ছেলে বেরোচ্ছে ভিড় ঠেলে। খোঁড়াতে খোঁড়াতে। এক পায়ের ফেডেড ব্লু জিন্স হাঁটুর কাছে ভিজে গেছে রক্তে। রুমাল দিয়ে এক চোখের ওপর চেপে ধরেছিল ছেলেটা। সেই ক্ষত থেকে রক্ত গাল গড়িয়ে ভিজিয়ে দিয়েছে কাঁধ আর জামার একাংশ। পাঁচতলা থেকে একেবারে নিচে দৌড়ে নামার পর হাঁপাতে হাঁপাতে দেখছিলাম দুজনে। দম বন্ধ হয়ে আসছিল যেন। মনের মধ্যে কেউ বলে উঠল, এ কি অশুভ, এ কি অশুভ...
এবারো কেউ ধরলনা ফোন সৌজন্যার বাড়িতে। সিঞ্জিনির কি মনে হল, বাড়িতে ফোন করল একবার। পাশে আমি দাঁড়িয়ে, শুনলাম জিজ্ঞাসা করছে, “মা সব ঠিক আছে তো?” এরপর আর আমার কানে পৌঁছায়নি কিছু। ফোন ছাড়ার পর দেখলাম ওর মুখ বিবর্ণ। আমার দিকে তাকিয়ে নিজেই বলে উঠল
---“কি হয়েছে আজ বল তো?”
আমি তখনো এক ভাবে তাকিয়ে আছি ওর দিকে। এটা তো আমারও প্রশ্ন, কি হচ্ছেটা কি আজ?! আমাকে চুপ দেখে নিজেই বলল সিঞ্জিনি,
---“এখুনি খবর পেলাম। ছোটকা আর নেই...”
দুপুরে রাস্তায় দুর্ঘটনায় প্রান হারিয়েছেন ওর ছোট কাকা। কোথাও ইন্টার্ভিউ দিয়ে ফিরছিলেন। “আমি চললাম” বলে বেড়িয়ে গেলো সিঞ্জিনি। মনে হল ওই মুহুর্তে কাকার মৃত্যুতে দুঃখের চেয়ে ও যেন শকড্ ছিল অনেক বেশী। কি যে হয়েছে আজ। আমি চুপচাপ ফিরে এসে ক্লাসে বসলাম। বন্ধুরা আমার আচরনে দ্বিগুন হতবম্ব। কেউ কেউ জিজ্ঞাসাও করেছিল বোধ হয়। সিঞ্জিনি কোথায় গেলো, সৌজন্যার ব্যাপারটা কিছু জানা গেলো কি না। কিন্তু তখন কিছু শোনার বা বলার মত অবস্থা ছিল না আমার। পর পর দুই ঘণ্টা ক্লাস করলাম। কি করলাম, কি দেখলাম, কি শুনলাম, কি বুঝলাম জানি না।
কলেজ থেকে বেরোনোর আগে আবার ফোন করা হল ওর বাড়িতে। এবার ফোন ধরল সৌজন্যা নিজে। ওর কান্না ভেজে স্বর শুনে প্রথমে বলতে পারলাম না কিছু। ভয়ানক ভয় চেপে বসেছিল মনে। কি শুনব... কি শুনব... অনেক কষ্টে বললাম,
--- “আমি পিয়ালি বলছি”
ডুকরে কেঁদে উঠল সৌজন্যা। জিজ্ঞাসা করতে চাইছিলাম কি হয়েছে বল প্লিজ, পারলাম না। ঢোঁক গিললাম একটা। তারপর কান্না সামলে ওই বলল,
---“সরি রে, তোদের কিছু বলে যেতে পারিনি। তোরা নিশ্চয়ই খুব টেনশনে ছিলি?”
---“অনেকবার ফোন করা হয়েছিলো তোর বাড়িতে”
---“বাড়িতে ছিলাম না কেউই। তোকে বনির কথা বলেছিলাম মনে আছে? আমার বেস্ট ফ্রেন্ড?”
---“হুম্...”
---“আজ ওর কার ক্র্যাশ করেছে একটা ফ্লাইওভারে। রেলিং ভেঙ্গে ফ্লাইওভারের থেকে নিচে পড়ে গেছে গাড়িটা। সেখানেই মারা গেছে ও”
---“আই অ্যাম সরি...”
---“কালই আমাকে ওই গাড়িতে ঘুরিয়েছে বনি। নতুন ড্রাইভিং শিখেছিল ও কিন্তু ভাগ্য দ্যাখ, ও আজ চালাচ্ছিলনা, চালাচ্ছিল ওদের ড্রাইভার। কিন্তু সে বেঁচে গেছে।” আবার কেঁদে উঠল সৌজন্যা।
ফোন ছাড়ার আগে চাপা স্বরে বললাম, “পিরামিডটা এখুনি ফেলে দিস।”
ও শুনল কি না জানিনা। অনেকগুলো জিজ্ঞাসু চোখ তখন আমার দিকে। বললাম সবাইকে। শুরু থেকে। এখন মনে আছে। বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের দ্বন্দে বন্ধুরা তাকিয়েছিল আমার দিকে। কিছুক্ষণ কেউ কথা বলেনি। এবার আমার কান্না বেরিয়ে আসতে চাইল গলা ছাপিয়ে। অনেক কষ্টে বললাম,
---“প্লিজ ডোন্ট ব্লেম মি...”
---“নোবডি ইস ব্লেমিং ইউ ডিয়ার। বাট হাউ ইট কুড বি? ”
কিন্তু কেউ বলল না যে এটা একটা কোইন্সিডেন্স। আর কিছু না। আর একটা খবর পাওয়া তখনো বাকী ছিল।
১২ই সেপ্টেম্বর
সকালে পেপারটা একটু ভালোভাবে দেখছিলাম। কোথাও সৌজন্যার বন্ধুর দুর্ঘটনার কথা প্রকাশ হয়েছে কিনা। হ্যাঁ, বেরিয়েছে খবরটা। পড়লাম। ...“অদ্ভুত ভাবে বেঁচে গিয়েছে গাড়ির চালক। কিন্তু গাড়ির পেছনে বসে থাকা বনি ডি-সুজার মৃত্যু হয় ঘটনাস্থলেই। প্রান হারান আরেক ব্যক্তি, যার উপর গাড়িটা পড়েছিল ফ্লাইওভার থেকে। ...নামক ভদ্রলোক তখন ইন্টার্ভিউ দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন...”
সত্যি এ যে কি হয়েছিল জানি না। পিরামিডটার সাথে ওই দুর্ঘটনার কোথাও যোগ আছে কিনা জানিনা। শহুরে মন আমাদের। এসব মানবে না সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অনেক শিক্ষা হয়েছে আমার ওই এক দিনে। এর পর কাউকে আর পিরামিড উপহার দেবনা অন্তত।
Download and install Avro Keyboard to
view the contents.
Mail us
to phoenix.punoruday11@gmail.com for pdf version of this
Magazine
bedonadayak lekha.......... bhalo laglo....
ReplyDelete