~: তথ্য জানার অধিকার :~
ডঃ অভিজিৎ গুহ
তথ্য জানার অধিকার আইন নিয়ে সম্প্রতি নানা ধরণের
সংবাদ মাধ্যম ও বই পত্রে আলোচনা হচ্ছে। এই আইনটিকে
গণতন্ত্র রক্ষার অন্যতম হাতিয়ার বলে মনে করা হচ্ছে। তথ্য জানার অধিকার আইন বা Right to Information Act (RTI Act, 2005) একমাত্র
জম্মু-কাশ্মীর ছাড়া ভারতবর্ষের সবকটি অঙ্গরাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলিতে বলবৎ
হয়েছে, যার মাধ্যমে কয়েকটি বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া একজন নাগরিক
যেকোনো সরকারী বা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের প্রায় সমস্ত রকম তথ্য জানতে পারবেন।
তথ্যঃ
সংসদ এর বাংলা অভিধান অনুযায়ী তথ্য শব্দটির অর্থ হল-
১) যাথার্থ্য, জ্ঞাতব্য বিষয়, আসল কথা,
ঠিক খবর, সত্য। ২) যথার্থ, প্রমাণিত, অবিসংবাদী। অর্থাৎ সত্য হিসাবে যা প্রতিষ্ঠিত
তাই তথ্য। কিন্তু
প্রশ্ন হল একজন নাগরিক সরকারের কাছে বা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কি ধরনের ‘সত্য’ বা ‘আসল খবর’ জানতে চাইতে পারেন? এর উত্তর জানার আগে আমাদের জানার
প্রয়োজন তথ্য জানার অধিকার আইন ও এর উদ্দ্যেশ্য।
তথ্য অধিকার আইনঃ
১৫ই জুন ২০০৫ এ তথ্য অধিকার আইনটি রাষ্ট্রপতির সম্মতি
নিয়ে লোকসভায় গৃহীত হয়েছিল। এর
উদ্দ্যেশ্য সম্পর্কে প্রথমেই বলা হয়েছে- “ইহার উদ্দ্যেশ্য
প্রত্যেক জন-কর্ত্তৃপক্ষের কাজে স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতার উন্নতি ঘটানো, কেন্দ্রীয় তথ্য আয়োগ ও রাজ্য আয়োগ স্থাপন এবং তৎসম্পর্কিত বা তৎসংশ্লিষ্ট
বিষয়গুলি নির্দিষ্ট করা”। অর্থাৎ এই
আইন প্রণয়নের মুখ্য উদ্দ্যেশ্যই হল প্রতিটি জন-কর্ত্তৃপক্ষের (Public Authority) কাজে স্বচ্ছতা (Transparency) ও দায়বদ্ধতার (Accountability) উন্নতি সাধন। সোজা কথায় যে কোনও সরকারী
কর্ত্তৃপক্ষ তাদের প্রতিটি কাজের জন্য জনগণ তথা করদাতাদের কাছে দায়বদ্ধ থাকবেন। এ প্রসঙ্গে দুটি উল্লেখযোগ্য বিষয়
হল- ১) জন কর্ত্তৃপক্ষ কাকে
বলব? ২) কোন কোন তথ্য জন কর্ত্তৃপক্ষ গোপন রাখতে পারেন?
জন-কর্ত্তৃপক্ষঃ
এই আইনে জন কর্ত্তৃপক্ষের সংজ্ঞায় বলা আছে- “জন কর্ত্তৃপক্ষ বলতে বোঝায় সেই সকল কর্ত্তৃপক্ষ, সংস্থা
বা স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানকে যেগুলি-
১)
লোকসভার দ্বারা বা সংবিধান অনুসারে স্থাপিত বা গঠিত;
২)
লোকসভার দ্বারা প্রণীত অন্য কোনও আইন অনুসারে স্থাপিত
বা গঠিত;
৩)
রাজ্য বিধানসভা কর্ত্তৃক প্রণীত অন্য কোনও আইন
অনুসারে স্থাপিত বা গঠিত;”
এছাড়াও সরকারী আদেশে গঠিত বা সরকারী মালিকানা বা
নিয়ন্ত্রিত, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকারী অর্থপ্রাপ্ত
প্রতিষ্ঠান এরা সকলেই এই আইনের আওতায় পড়ে। অর্থাৎ সরকারী, আধা-সরকারী, বেসরকারী কোম্পানী বা প্রতিষ্ঠান,
স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়
এমনকি যেকোনো স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও তথ্য অধিকার আইন মেনে চলতে বাধ্য।
কোন
তথ্য জন কর্ত্তৃপক্ষ গোপন রাখতে পারেনঃ
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এই যে- এমন কোনও তথ্য আছে কি, যা পাওয়ার অধিকার নাগরিকের নেই? কারণ, বহু উচ্চপদস্থ আমলারা এখনো ভাবেন সবকিছু সাধারণ মানুষকে জানানোর কোনও অর্থ
নেই; প্রতিনিয়ত তথ্য জানাতে হলে প্রশাসন চলবে কি করে?
আবার অনেকে ভাবেন, সব তথ্য জানালে লাভের চেয়ে
ক্ষতি বেশি। অন্যদিকে
মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে- সত্যিই কি এই আইন অনুযায়ী সব রকমের তথ্য আমরা জানতে পারি? ব্রিটিশ আমলে আমাদের দেশে গোপনীয়তা সংক্রান্ত আইন প্রবর্তিত ছিল। ১৯২৩ সালে
প্রবর্তিত হওয়া এই আইনের পোশাকী নাম ছিল “Official Secrets Act”। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরও এই উক্ত
ঔপনিবেশিক আইনের কোনও মূলগত পরিবর্তন হয়নি। Official Secrets Act, 1923 অনুযায়ী
সরকারী কোনও তথ্য জন সমক্ষে প্রকাশ করতে বাধ্য নন। কিন্তু তথ্য অধিকার আইন (২০০৫) চালু
হওয়ার পর যেকোনো সরকারী তথ্য নাগরিকের কাছে প্রকাশযোগ্য। তবে কিছু তথ্যের উপর নাগরিকের
অধিকার নেই, যা এই তথ্য অধিকার আইনের ৮নং ধারায় পরিষ্কার লেখা
আছে।
তথ্য অধিকার আইনের ৮ নং ধারা অনুযায়ী নিম্নে
নির্দিষ্ট তথ্যগুলি প্রদান করতে কোনও জন কর্ত্তৃপক্ষ দায়বদ্ধ নন-
ক)
এমন তথ্য যাহার প্রকাশ ভারতের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা, নিরাপত্তা, রাষ্ট্রের রণনীতি বা কৌশল, বৈজ্ঞানিক বা অর্থনৈতিক স্বার্থ বা অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের পক্ষে
ক্ষতিকারক বা যাহা অপরাধ প্ররোচনামূলক।
খ) এমন তথ্য যাহার প্রকাশ আদালত বা ট্রাইব্যুনাল
কর্ত্তৃক পরিষ্কার-রূপে নিষিদ্ধ করা হইয়াছে অথবা যাহার প্রকাশ আদালত অবমাননাকর।
গ)
এমন তথ্য যাহার প্রকাশে আইনসভা বা বিধানসভার
বিশেষাধিকার ভঙ্গ করা হইবে।
ঘ)
বাণিজ্যিক বিশ্বস্ততা, ব্যবসায়ের
গুপ্ত তথ্য, উদ্ভাবনী মেধা সম্পদ (Intellectual Property) সমেত যে সকল তথ্যের
প্রকাশ কোনও তৃতীয় পক্ষের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানের পক্ষে ক্ষতিকর, অবশ্য যদি না যোগ্য কর্ত্তৃপক্ষ এ বিষয়ে সন্তুষ্ট হন যে বৃহত্তর
জনস্বার্থের খাতিরে এই তথ্য প্রকাশ করা যাইতে পারে।
ঙ)
যে তথ্য কোনও আস্থা-ভাজন সম্পর্কের জন্য
স্বাভাবিকভাবেই গোচরীভুক্ত, অবশ্য যদি না যোগ্য কর্ত্তৃপক্ষ এ
বিষয়ে সন্তুষ্ট হন যে বৃহত্তর জনস্বার্থের খাতিরে এই তথ্য প্রকাশ করা যাইতে পারে।
চ)
বিদেশী সরকারের নিকট হইতে গোপনসুত্রে প্রাপ্ত তথ্য।
ছ)
এমন তথ্য যাহার প্রকাশ কোনও ব্যক্তির জীবন বা দৈহিক
নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক হইতে পারে বা আইন কার্যকর করা বা নিরাপত্তার
উদ্দ্যেশ্যে প্রদত্ত তথ্য বা সহায়তার পরিচয় প্রকাশ করিয়া দিতে পারে।
জ)
যে তথ্য তদন্ত প্রক্রিয়ায় অথবা অপরাধীর গ্রেফতার বা
বিচারে বাধার সৃষ্টি করিতে পারে।
ঝ)
ক্যাবিনেট সংক্রান্ত নথিপত্র ও মন্ত্রী পরিষদ, সচিব ও অন্যান্য আধিকারিকগনের মত বিনিময় সংক্রান্ত নথিপত্র।
ঞ)
ব্যক্তিগত তথ্য, যাহার প্রকাশের
সহিত জনসাধারণের কাজকর্ম বা স্বার্থের কোনও সম্পর্ক নাই অথবা যাহা কোনও ব্যক্তির
নিতান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপারে অকারণ আক্রমণের তথ্য অবশ্য যদি না সংশ্লিষ্ট তথ্য
কমিশনের আধিকারিক বা আপীল কর্ত্তৃপক্ষ এ বিষয়ে সন্তুষ্ট হন যে জনের বৃহত্তর
স্বার্থে এই তথ্য প্রকাশিত করা যাইতে পারে।
শর্তসাপেক্ষে যে তথ্য আইনসভা বা বিধানসভায় দিতে
অস্বীকার করা যায় না সেই তথ্য কাহাকেও দিতে অস্বীকার করা যাইবে না।
উপরে উল্লেখ করা বিষয়গুলি ছাড়া মোটামুটি বাকি সমস্ত
তথ্য জন কর্ত্তৃপক্ষ ভারতবর্ষের নাগরিককে দিতে বাধ্য। অবশ্য উপরিউক্ত বিষয়গুলির সম্পর্কে
তথ্য সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় প্রয়োজন হয়না বললেই চলে। এই কারণেই তথ্য অধিকার আইন সম্বন্ধে
প্রত্যেক নাগরিকের সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজন।
(ক্রমশ...)
Download and install Avro Keyboard to
view the contents.
Mail us
to phoenix.punoruday11@gmail.com for pdf version of this
Magazine
No comments:
Post a Comment