আমি
সেই মেয়ে
সুদীপ্ত
চ্যাটার্জী
পুজোর
আর এক মাস বাকী। সেই জন্যই
মেট্রোতে অসম্ভব ভিড়। অফিসের
কাজ সেরে ফিরতে শুভর রোজ দেরি
হয়ে যাচ্ছে। আজও সে কোন রকমে
শেষ মেট্রোতে উঠে একটা বসার
যায়গা পেয়েছে। একটু স্বস্তি
করে বসার পর দমদম ছাড়ল মেট্রো।
কখন যে ক্লান্তি শুভর চোখ
জুড়িয়ে দিল টেরও পেলনা শুভ।
সেন্ট্রাল স্টেশনে হটাৎ জোরে
ট্রেন থেমে যেতে শুভর ঘুম ভেঙে
যায়। চোখ খুলেই সে অবাক দৃষ্টিতে
সামনের দিকে দেখতে থাকে। কি
অপরুপ দেখতে ওকে। নিজের অজান্তেই
সে মেয়েটির দিকে অবাক দৃষ্টিতে
তাকিয়ে থাকে। অসম্ভব চেনা
লাগছে। কিন্তু চিনতে পারছেনা।
শেষ
মেট্রো। তাও পা রাখার জায়গা
নেই বললেই চলে। একগাদা কনুই
এর মাঝে বড়ো অসহায় লাগছে ওকে।
শুভ নিজের সিটটা মেয়েটিকে
অফার করতে কেমন একটা অদ্ভুত
ভাবে শুভর দিকে তাকালো সে।
কিছুটা ঘাবড়ে গেলো শুভ। তারপর
অবশ্য শুভর যায়গায় এসেই বসলো।
বাকী রাস্তা দুজনের দৃষ্টি
বিনিময় হলেও বাক্য বিনিময়
করার সাহস কেউই দেখালো না।
ইতিমধ্যে রবীন্দ্র সরোবর
ষ্টেশন ছেড়ে দিল মেট্রো। পরের
স্টেশনে শুভ কে নামতে হবে।
সে এগিয়ে গেলো দরজার দিকে।
যাওয়ার সময় মেয়েটির দিকে
তাকিয়ে একটা মিষ্টি হাসল।
মেয়েটিও তার জবাব দিল।
--‘দাদা,
এটা
সখের বাজার এর লাইন?’
--‘হ্যাঁ।’
মেট্রো
থেকে নেমে শুভ অটোর লাইনে
দাঁড়ালো। কিন্তু ওই দুটো চোখ
সে ভুলতে পারছে না। সে মেয়েটির
কথাই ভাবতে থাকে। কে মেয়েটি?
--‘ও
দাদা!
এবার
নামুন অটো থেকে।’
অটোওয়ালার
কথায় হুঁশ ফিরলো শুভর। সে
খেয়ালই করেনি কখন বাড়ির সামনে
চলে এসেছে।
“তোর
ছোটবেলা মনে পড়ে?
কি
জানি কেন,
ক-দিন
খালি বারবার আমার মনে ছোটবেলা
ঘুরে বেড়াচ্ছে। তোরও কি মনে
পড়ে?
আমাদের
ছোটবেলা তো বেশি দূর না। আট-দশ
পা পিছিয়ে গেলেই তো পৌঁছে
যাওয়া যায়। আচ্ছা এক্কা-দোক্কা,
কুমীরডাঙ্গা
খেলার কথা মনে আছে তোর?
তোর
বন্ধুরা খুব ক্ষেপাত আর তুই
আমার উপর আর বলতিস কাল থেকে
তোর সাথে আর খেলবোনা,
কিন্তু
বিকেল হলেই ঠিক চলে আসতিস।
আর সেই দিনটার কথা মনে পড়ে?
শীতকাল
ছিল হয়ত,
জানুয়ারী
মাস,
তাই
না?
আমি
তো সোয়েটার-টুপি
পরে একটা মস্ত বড় বল হয়ে,
তোর
দাদুর সাথে ঘাটে বসেছিলাম।
হটাৎ তোর ইচ্ছে হল প্রদীপ
ভাসাবি। দাদুর কাছে পয়সা নিয়ে
প্রদীপ কিনে ঘাটে নামলাম আর
তারপর...
পা
পিছলে একদম জলে। ভাগ্যিস ঘাট
ভর্তি লোক ছিল। হৈ-হৈ
করে তুলে ফেলল। আর আমি তখন
ঠাণ্ডায় কাঁপছি ঠকঠক করে।
সোয়েটার সুদ্ধ ভিজে একেবারে
রসগোল্লা। আর তুই বাড়ী ফেরার
পথে সারা রাস্তা হেসেছিলি।
আমার খুব কান্না পাচ্ছিল।
কিন্তু একটুও কাঁদিনি। শুধু
বাড়ী ফেরার সময় তোর দিকে তাকিয়ে
আড়ি বলে চলে গিয়েছিলাম। তারপর
আর কথা বলিনি। পরের দিন তুই
খেলতে এসেছিলি,
আমি
খেলিনি। চুপ করে বসেছিলাম।
একটু ঘাবড়ে গেছিলিস তুই,
তাই
না?
ভেবেছিলি
ছিঁচকাঁদুনে মেয়েটা আজ
কাঁদছেওনা,
ঝগড়াও
করছেনা। কিছুক্ষণ থেকে তুই
চলে গিয়েছিলিস,
মন
খারাপ করে। পরের দিন তুই আমায়
একটা সুন্দর পেন দিয়ে বলেছিলি
‘এবার
ভাব তো?’
আমি
নেবোনা -
নেবোনা করে
নিয়েছিলাম। আর সেই দিন তোকে
জব্দ করার রাস্তাও পেয়েছিলাম।
ঝগড়া
হলেই আমি কথা বন্ধ করে দিতাম।
তারপর বন্ধু,
খেলার
মাঠ,
স্কুল
সব বদলে গেল। আমরা বড় হতে
লাগলাম। স্বপ্ন দেখতে লাগলাম
গঙ্গার ঘাট,
গড়ের
মাঠ,
চিকেন
কাবাব,
গ্যাস
বেলুন,
কলকাতার
ধোঁয়া,
গুলাম
আলী-
দের
নিয়ে। কিন্তু আমরা বদলে গেলাম
না। আমার একটু রাগ হলেই আড়ি,
আর
কথা বন্ধ। আর তুই ভাব করার
জন্য অস্থির হয়ে উঠতিস –
মনে পড়ে?
আজ
তুই কতদুর,
কতদিন
দেখিনি তোকে। একদিন আসবি?
বিশ্বাস
কর,
আমি
পাল্টে গেছি।
আর
আড়ি করবোনা”।
...
আজ
বহুদিন পর,
শুভ
শ্রেয়ার এই শেষ চিঠিটা পড়ল।
শুভ বুঝতে পারছে না শ্রেয়ার
সাথে ওই মেয়েটার এত মিল পাচ্ছে
কেন। শ্রেয়ার শেষ চিঠি পাওয়ার
পরের দিনই শুভ ছুটে গিয়েছিল
গ্রামের বাড়িতে। কিন্তু সেখানে
গিয়েই জানতে পারে আট দিন আগে
শ্রেয়ার বাবা মারা গেছে। তাই
তার মামা শ্রেয়া আর কাকিমাকে
নিয়ে চলে গেছে কোলকাতায়।
কিন্তু
ঠিকানা?
কারো
কাছে নেই। সেই পাঁচ বছর আগে
গিয়েছিল গ্রামের বাড়ী। তারপর
থেকে গ্রামের সাথে কোনও যোগাযোগ
নেই। শ্রেয়ার সাথে তো আরোই
নেই।
আজ
হটাৎ চোদ্দ বছর পুরনো কথা খুব
মনে পড়ছে। শুভ বারবার মনে করছে
তার পুরনো শ্রেয়াকে সে কি আবার
খুজে পেলো?
পরের
দিন সে হন্যে হয়ে খুঁজতে শুরু
করলো গোটা ট্রেন। প্রথম থেকে
শেষ পর্যন্ত। কিন্তু পেলোনা।
তার পরের দিন ও পেলোনা। শুভ
রোজ খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু
পায়না। আজ পঞ্চমী। আজও শুভ
খুঁজে বেড়াচ্ছে মেয়েটিকে।
হটাৎ
কালীঘাট ষ্টেশনে দেখে ওই রকম
দেখতে একটি মেয়ে ট্রেন থেকে
নামছে। ছুটে গেল দরজার দিকে।
কিন্তু
শ্রেয়াকে পাওয়ার আগেই বন্ধ
হয়ে গেল দরজা। সেদিন বাড়ি ফিরে
প্রথমবার কলম ধরলো শুভ।
লিখলো---
ছাই
চলে
যাব যেদিন চৌকাঠ পেরিয়ে,
পোড়া ডিজেলের
গন্ধ নাকে আসবেনা আর।
ছেড়ে
দেব লাল-নীল-হলুদ
গ্যাস বেলুনের সুতো,
ঘাসের ডগায় শিশির
বিন্দু দেখবো না আর।
রং-তুলি
দিয়ে আঁকা যত আঁকিবুঁকি,
জ্বলবে পুড়ে
উদ্দাম আনন্দে।
দরজার
পিছনে থেকে জীবন্ত পিঙ্ক
ফ্লয়েড,
সকালের কুর্নিশ
পাবে না আর।
জানালার
ঝোলা ছেঁড়া মোজা দুটো,
গ্রীলেতেই কোন
দিন হবে শেষ।
পুরনো
ডায়রির ভাঁজে আটকে থাকা
‘আমি-তুমি’-টাই,
থাকবে পড়ে আমার
অবশেষ।
সেদিন
আমি রবী ঠাকুর আওড়াবো,
‘যখন
পড়বেনা মোর পায়ের চিহ্ন এই
বাটে’
সেদিন
আমি কবিত্ব ছেড়ে দেব,
কোনদিন কলম ধরবনা
আর এই হাতে।
তেঁতুল
গাছের গোঁড়ায় আমায় পাবে,
পাবে
তোমার পঞ্চাশ টাকার চিকেন
কাবাবে,
পাবে
আমায় ‘লিঙ্কিং
পার্ক’
থেকে ‘গুলাম
আলী’
তে।
পাবে
আমায় ফাঁকা ওই গড়ের মাথে,
আর গঙ্গায় ভাসতে
থেকে ওই নৌকার বুকে।
জানিনা কোথায়
গিয়ে শেষ করবো আমি।
চাইলেও ছুঁতে
পারবে না কোঁড়ে আঙ্গুলটা আর।
চলে
যাব যেদিন চৌকাঠ পেরিয়ে,
পোড়া ডিজেলের
গন্ধ নাকে আসবেনা আর।।
Download and
install Avro Keyboard to view the contents.
Like our
Facebook Page- http://www.facebook.com/phoenix.punoruday
No comments:
Post a Comment