শুভ্রামোনিয়াম
রূপঙ্কর
সরকার
“-আরে,
আপনি
সাউথ ইন্ডিয়ান?”
নতুন
ম্যানেজার জিজ্ঞেস করলেন।
“অবশ্য
কলকাতায় সাউথ ইন্ডিয়ান প্রচুর,
সব
অফিসেই কয়েক জনকে পাওয়া যায়।
তা বাংলা তো ভালই বলেন,
বহুদিন
আছেন নিশ্চয়।”
জলের
গ্লাসটা একটু বাড়িয়ে দিয়ে
দিদি বললেন-
“না
স্যার,
আমি
বাঙালি,
বাঙাল।
আমার পদবী গোস্বামী।”
স্যার
অবশ্য জলের গ্লাসটা নিলেন
না। আসলে কেউই বড় একটা নেয়না।
অফিসের দেয়ালে ওয়াটার পিউরিফায়ার
লাগানো আছে,
কুলারও
আছে। প্রত্যেকের টেবিলে পেট
বোতল আছে নিজস্ব। যে যার জল
ধরে আনে ইচ্ছে মত। দিদি তবু
একটা হাতল লাগানো কেরিয়ারে
ছ’খানা
গ্লাসে জল ভরে টেবিলে টেবিলে
ঘোরান,
ওটাই
তাঁর চাকরি। জিজ্ঞেস করলে
বলেন-
আমি
‘ওয়াটার
বয়’।
সবাই
তো সমান নয়,
নতুন
কয়েকটা ফক্কড় ছোকরা,
শুধু
ছোকরা কেন,
এক
ছুঁড়িও আছে তাদের দলে,
তারা
বলে “ও
দিদি,
আপনি
বয় কী করে হবেন,
ওয়াটার
গার্ল হতে পারেন বড়জোর। যদিও
গার্ল হবার বয়সও পেরিয়ে গেছে।
আপনি আমাদের ওয়াটার লেডি।”
অফিসে
একজন বড়বাবু আছেন। আছেন মানে,
ইনিই
শেষ। সাইবার যুগে খাতা পেন্সিল
হাতে বড়বাবু টাবু আর চলেনা।
ইনি রিটায়ার করলে পদটাও আর
থাকবেনা। তবু যতদিন আছেন...
তা
এই বড়বাবু একদিন রুখে দাঁড়ালেন-
“বলি
ও ছোটসাহেব,
শুভ্রা
কী করে ওয়াটার বয়,
তাই
তো?
ক্রিকেট
খেলা দেখেন নাকি?
আজকাল
মেয়েরাও ক্রিকেট খেলে জানেন
তো ?
ব্যাটসম্যান
কে তো এখন কায়দা করে ‘ব্যাটার’
বলা হয়
কিন্তু থার্ডম্যান পোজিশনে
যে মেয়েটি ফিল্ডিং করছে,
তাকে
কী বলে আপনারা?
হেঁ
হেঁ হেঁ...”
শুভ্রাদি
খুব কৃতজ্ঞ বড়বাবুর কাছে।
উনিই কেবল সহমর্মী।
টিফিনে
বেরিয়ে দু খিলি পানই কিনে
আনলেন বড়বাবুর জন্য। প্রাচীন
পোস্টে আসীন প্রাচীন মানুষটার
নেশাও প্রাচীন। এদিকে
‘শুভ্রামোনিয়াম’
নামটা অফিসে
চালু করার পেছনে যে এনারই হাত
ছিল বাইশ বছর আগে,
তাও
শুভ্রাদির অজানা নয়,
কিন্তু...
যাক
সে সব কথা। নামটাও কেমন গা
সওয়া হয়ে গেছে। বড়রা তো বটেই,
নতুন
ছেলেগুলোও ডাকে,
‘ও
শুভ্রামোনিয়াম দি...’
ম্যানেজারবাবু
বললেন-
“অ!!
তাহলে
আপনি বাঙালি,
আবার
বাঙাল?
আমি
কিন্তু খাস ঘটি,
দর্জিপাড়ার
ছেলে।
তা সে
যাকগে,
আপনাকে
সুব্রাহ্মণিয়ম বলে ডাকে কেন
সবাই?
অবশ্য
আপনার পার্সোনাল ব্যাপার
জানার আমার খুব একটা ইচ্ছে
নেই। তবে আপনি জল হাতে ঘুরে
বেড়ান কেন সারাদিন?
সবাই
তো নিজের নিজের বট্ল থেকে
জল খায়। ওসব সার্বজনীন গ্লাস
থেকে ভদ্রলোকে জল খায় নাকি
আজকাল?
না,
এতো
চলবেনা,
মাইনে
নিচ্ছেন যখন কাজ তো করতে হবে।
কাল থেকে আপনি ডেটা কার্ডগুলো
গুছিয়ে রাখবেন। প্রথমে এই
দিয়ে শুরু করুন,
এর
পরে ইনডেক্সিংও করতে হবে।
কতদূর পড়াশোনা আপনার ?”
বড়বাবু
ঘরে ঢুকে বললেন,
“নোস্কার
স্যার,
আমি
নবীন নস্কর,
বড়বাবু।”
স্যার
বললেন-
“এখানে
তো সবই উল্টো দেখছি। বাঙালি
মহিলার নাম সুব্রাহ্মণিয়ম,
প্রবীন
ব্যক্তির নাম নবীন,
হ্যাঁ,
তা
কী মনে করে?”
বড়বাবু
বললেন-
“আমি
শুধু বড়বাবু না,
এখানকার
স্টাফ অ্যাসোসিয়েশনের
প্রেসিডেন্ট। স্যার শুভ্রা
তো জল দেওয়া ছাড়া কিছু করবে
না। ওর তো ওটাই ডেসিগনেশন।”
স্যার
বললেন-
“তাই?
আচ্ছা,
মণিপুর
জায়গাটা কেমন?”
বড়বাবু
বললেন-
“জানিনা
স্যার কোনওদিন যাইনি।”
স্যার
বললেন-
“এবার
যাবেন। আর বোধহয় বছর দুয়েক
চাকরি আছে,
না?
তা
ওখান থেকেই রিটায়ার করবেন।
শুনুন মিস্টার প্রবীন নস্কর...”
বড়বাবু
বললেন-
“নবীন
স্যার।”
“হ্যাঁ,
মিস্টার
নস্কর,
অ্যাসোসিয়েশন
ফন এখন আর চলছেনা,
জানেন।
তিন রকম পোলিটিকাল পার্টি
ঢোকানো হয়েছে। আপনারা আমায়
ঘেরাও করলে,
অন্য
একটা দলকে লেলিয়ে দেব। ক্লিয়ার?
যান,
আপনার
যাত্রা শুভ হোক। আপনাকে প্লেনে
যাবার পারমিশন করে দিচ্ছি।”
নেপালি
ছেলেটার নাম রাই। কম কথা বলে,
ও
বলল-
“দিদি,
এই
কার্ডগুলো নম্বর মিলিয়ে মিলিয়ে
একটা করে সেট বানান। হয়ে গেলে
বলবেন,
আমি
চেক করে দেব।”
শুভ্রা
গোস্বামী ম্যানেজারের ঘরে
চলে গেলেন। “স্যার,
আমি
তো এসব কাজ কোনওদিন করিনি”।
স্যার খুব ব্যাস্ত ছিলেন,
বললেন-
“অন্নপ্রাশনের
আগে ভাতও তো খাননি কোনওদিন।
সব অভ্যাস হয়ে যাবে মিস
সুব্রাহ্মণিয়ম। মিস না মিসেস?
ওকি,
কান্নাকাটির
কী হল,
ঠিক
আছে,
এখন
যান। আজকে নাহয় জলের গ্লাস
নিয়েই ঘুরুন,
কিন্তু
ডেটা কার্ড আপনাকে সামলাতেই
হবে। না পারলে বলবেন,
প্রচূর
বেকার ছেলেমেয়ে ঘুরছে বাজারে।”
রাই
বলল-
“দিদি,
আপনি
ভয় পাবেন না,
আমি
প্রথম প্রথম আপনাকে হেল্প
করে দেব। কিন্তু আস্তে আস্তে
আপনাকে কাজটা তো ধরতে হবে।
আপনি নিশ্চয় ইংলিশ লিখতে পড়তে
পারেন।
আচ্ছা
আপনাকে সবাই সুব্রাহ্মণিয়ম
বলে ডাকে কেন?”
শুভ্রা
বললেন-
“আমরা
বাঙালি,
বাঙাল,
ব্রাহ্মণ,
গোস্বামী
পদবী। আমার বাবা পূব বাংলা
থেকে পালিয়ে এসে কোনও চাকরি
বাকরি পাচ্ছিল না। এখানে
ওয়াটার বয় হিসেবে ঢুকিয়ে দিলেন
একজন আমাদের গ্রামের লোক।
বাবা মারা যেতে সেই পদে আমি
ঢুকলাম। বাবা অনেকদূর পড়েছিল
কিন্তু আমি হায়ার সেকেন্ডারি।
আমার মা আর এপারে আসতে পারেনি
ওপারেই দাঙ্গায়...”
রাই
বলল-
“স্টপ
ইট,
ভাল
লাগছেনা। আমি যতদিন পারি আপনার
কাজ করে দেব। কিন্তু সুব্রাহ্মণিয়মের
গল্পটা বললেন না...”
বড়সাহেব
বললেন,
“রাই,
তোমার
অ্যাসিস্ট্যান্ট কেমন কাজ
শিখছেন?
একটু
ধরে ধরে শেখাও,
কয়েক
দিনেই শিখে যাবেন”।
রাই
বলল-
“স্যার,
উনি
স্কুল লেভেল পাশ করেছেন কিন্তু
অনেকদিন পড়াশোনা অভ্যাস
নেই...”
স্যার
বললেন-
“অভ্যাস
কারও থাকেনা ভাই,
ওটা
করতে হয়। আসলে আমরা যে সব কাজ
করি,
একটু
কম্পিউটার হ্যান্ডল করা বাদ
দিলে বাকি কাজগুলোয় স্কুল
লেভেলের বেশি বিদ্যে লাগেনা।
কেন যে এরা কাঁড়ি কাঁড়ি ডিগ্রী
চায়...
যাকগে,
কই
তাঁকে ত দেখছি না,
মিস
সুব্রাহ্মণিয়ম?”
রাই
বলল-
“তিনি
তো সেদিনের পর থেকে আর আসেননি
স্যার।”
ম্যানেজার
বললেন-
“সে
কী!!
ছুটির
দরখাস্ত দিয়েছেন?”
বস্তির
ছেলেগুলো এমনিতে মালমূল খায়,
অশ্রাব্য
ভাষায় গালিগালাজ করে,
কিন্তু
সেদিন খুব ধকল গেল সবার। থানায়
ছোটাছুটি,
পোস্ট
মর্টেম করানো,
সেখানে
আবার মোটা ঘুষ ছাড়া বডি দেয়না।
যতই বলল,
এর
তিনকুলে কেউ নেই।
আমরা তো
পাশের বস্তিতে থাকি,
গরীব
মানুষ,
তাও
ছাড়লনা। বলে সুইসাইড কেসে
রেট বেশি।
আন্না
পিসি আঁচলের খুঁট দিয়ে বার
বার চোখ মোছে আর বলে-
“মেয়েটা
অত বিদুষী হয়েও সেই যে পিতিজ্ঞে
করেছেল,
কোনওদিন
পড়াশোনার কাজ করবেনে...”
বাবুর
মা বলল-
“কেন
গো দিদি?”
আন্না
পিসি বলে-
“ওর
বাবা,
সেই
পাকিস্তান থেকে নিজের বৌকে
বাঁচিয়ে আনতে না পারলে কী হবে
হারমোনিয়ামটা প্রাণ দিয়ে
আগলে এনেছিল। কি মিষ্টি গলা
ছেল গোঁসাই ঠাকুরের। মেয়েটাও
তো ভালই গাইত,
কিন্তু
বাপ বলে তোর গান হচ্ছেনে,
তোর
সুর বসেনে ঠিকমত,
তোর
তো গানের চেয়ে পড়ার দিকে ঝোঁক
বেশি। আমার হারমোনির হেপাজত
কে করবে গো। তা মেয়ে রেগে মেগে
পিতিজ্ঞে করল,
আমি
সারাদিন এই হারমোনিতে গলা
সাধব আজীবন। বই কাগজে হাত
দোবোনি প্রাণ থাকতে। তাই তো
লোকে ক্ষেপাত ওকে ‘শুভ্রামোনিয়াম’
বলে। সত্যি
মিথ্যে জানিনা ভাই,
কে
যেন বলছিল,
ওর
আপিশে নাকি ওকে লেখাপড়ার কাজ
করতে দিয়েছিল..
এখন
‘হারমোনিটার’
কী হবে?”