বিহঙ্গ
সুমনা ভট্টাচার্য্য
১
একতলার
বারান্দা থেকে আলতো পায়ে,
সামনের
বাঁধানো চাতালে নামল অজন্তা।
পরনে
নীল রঙের কটস উলের সালয়ার
কামিজ,
নীল
সোয়েটার,
নীল
শালের ওড়না।
গলায়
ঝুলছে ক্যামেরা।
সোয়েটারের
এক পকেটে রুমাল আরেকটায় চাবি।
মোবাইল
আর মানিব্যাগ ঘরেই আছে।
সারাক্ষণ
মোবাইলে কথা বলা,
তার
দু চোখের বিষ।
কেউ
মাঝে ফোন করলে,
ফিরে
গিয়ে রিং ব্যাক করলেই হবে।
প্রথমেই
বাঁদিকের আম গাছের ডালে চোখ
পড়ল,
যেখানে
একটা কোটরে থাকে,
প্যাঁচা
পরিবার।
পরিবারে
আপাতত সদস্য তিনজন-জনক
জননী ও সন্তান।
আজ
গোলগাল নরমতরম শাবক টি বসে
আছে,
বাবা
মা হয়তো বাইরে,
খাবারের
খোঁজে।
অনেক
ছবি তুলেছে সে,
এই
পরিবারের,
গত
দু সপ্তাহে দেরাদুনে আসার পর
থেকে।
আজ
শুধু মৃদু হেসে তাকালো সে
শাবকটির দিকে।
বাৎসল্যের
প্রকাশ যেমন হয়,
ঠিক
তেমন।
কেমন
এক আত্মীয়তা হয়ে গেছে পাখিগুলোর
সাথে অজন্তার।
সামনেই
একটা চাঁপা গাছ,
যেখানে
আসে মেরুন ওরিয়োল আর হাঁড়িচাঁচা,
দুপুরে
ফল খেতে।
সামনের
কেয়ারি করা মরসুমি ফুলের
বাগানে,
ছোট্ট
টিয়া সবুজ রঙের,
সাদা
বড় চোখ,
‘ওরিয়েন্টাল
হোয়াইট আই’,
মধু
খায় চন্দ্রমল্লিকায়,
লাফিয়ে
বেড়ায় ফুলে ফুল।
লাল
সবুজ ফুলের,
বটল-ব্রাশ
গাছে,
বসে
থাকে লাল-সবুজ
‘ক্রিমসন সানবার্ড’,
যার
শরীরের উর্ধাঙ্গ লাল আর নিচের
দিক টা সবুজ।
প্রকৃতির
কি অদ্ভুত সৃষ্টি,
নিজের
সন্তান-সন্ততিদের
বাঁচানোর।
দুদিন
লাগাতার ঝড় বৃষ্টি আর বিদ্যুৎ
বিভ্রাটের পর,
গতকাল
রোদ উঠেছে।
উপত্যকায়
বৃষ্টির ও আলাদা সৌন্দর্য্য।
২
আজ
ক্যাম্পাসের পেছনে মুসৌরি
পাহাড়ের গায়ে বরফের মুকুট,
প্রকৃত
যেন সত্যি হাসছে।আকাশ
পরিষ্কার নীল উজ্জ্বল,
সাথে
কনকনে ঠান্ডা আবহাওয়া।
এখানকার
জলবাতাস,
সরল
মানুষের কথা মনে পড়ায়,
যারা
মনের আকাশে মেঘ হলে,
সব
উগরে দিয়ে,
নির্মেঘ
গগন নিয়ে বাঁচে।
ধূসরতা
বা কালিমা স্পর্শ করতে পারে
না তাঁদের।
অজন্তা
নিজে ও এমন প্রকৃতির,
আর
চায়,
এই
স্বভাব যেন আজীবন সঙ্গী হয়
তার।
কলকাতায়
এমন নীল আকাশ দেখা যায় কদাচিৎ,
বর্ষা
কালে,
মুষলধার
বৃষ্টির পর,
রোদ
উঠলে।
বসু
বিজ্ঞান মন্দিরে সে বৈজ্ঞানিক।
পরবর্তী
পদন্নোতির আগে,
বাধ্যতামুলক
এই আট সপ্তাহের প্রশিক্ষণ।
তাই
সে এসেছে দেহরাদুনে।
থাকা
হোস্টেলে,
খাওয়া
মেসে।
অজন্তার
সাথে যারা ট্রেনিং করতে এসেছে,
দেশের
বিভিন্ন প্রান্ত থেকে,
তবে
তারা পক্ষিপ্রেমিক নয়,
তাই
সে একাকি বেরিয়ে পড়ে ছুটির
দিনে।
কলকাতায়
এত রকমের পাখি বা প্রকৃতিকে
এত নিবিড় করে পাওয়া যায় না।
তবু
ও মাঝে মাঝে সে বেড়িয়ে পড়ে
সল্ট লেকের বনবিতানে,
সকালের
দিকে,
যখন
ভিড় কম।
তবে
তার জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে
হয়,
এখানে
তো নাকের ডগায় সবকিছু।
অতএব,
কলকাতায়
যা করা হয় না,
তা
মন দিয়ে করে নিচ্ছে এইখানে
এসে।
গতকাল
সন্ধ্যায় রাজপুর রোডের নটরাজ
পাবলিশার্স থেকে “দুন ভ্যালির”
পাখির একটা বই কিনে এনেছে সে,
এবার
পাখিদের চেনা আরো সহজ হবে।
সোম
থেকে শুক্র,
পাঁচ
দিন লাগাতার ক্লাস,
শনি
রবি ছুটি।
এ
দুটো দিন,
সে
নিজের মতন করে কাটায়।
গত
শনিবার রবিবার ও পাখীর ছবি
তুলে,
পাখি
চিনে কাটিয়েছে সে।
গতকাল
ও সেই ভাবেই কেটে গেল।
আজ
রবিবার,
আজ
ও ক্লাস নেই,
তবে
নিজের স্থির করা রুটিনে,
সে
সকাল সকাল স্নান করে,
তৈরি
হয়ে,
ব্রেকফাস্ট
সেরে,
বেরিয়ে
পড়েছে।
মাঝে
মাঝে মনে হয়,
সে
যদি পাখীর মতন উড়ে বেড়াতে
পারত,
তবে
বেশ হত।
নানান
জায়গায় ঘুরতো,
খেয়াল
খুশি মত।
টিয়াপাখির
কর্কশ ডাকে,
সম্বিৎ
ফেরে তার।
মাথা
তুলে শব্দের উৎসস্থল খোঁজে
সে।
জাম
গাছের দিকে তাকাতেই,
নজরে
পরে দুটো লাল ঠোঁটের টিয়াপাখি
খুনসুটি করছে।
এখানে
নানারকমের টিয়াপাখি,
কোনোটার
ঠোঁট হলুদ,
কোনোটার
মাথা লাল বা ধুসর।
টিয়া
দম্পতি কে ফ্রেমবন্দি করে
এগোয় সে।
হলদে
বুক আর কালো মাথার বেনেবউ খুব
চঞ্চল,
এক
বার গাছের এই ডালে আরেক বার
সেই ডালে।
একপলকে
দেখে শুধু তাকে অজন্তা,
সব
পাখি কে ফ্রেমবন্দি করা যায়
না,
যেমন
জীবনের সব ইচ্ছে পুরন হয় না।
তবে
এই নিয়ে মনে কোনো দুঃখ নেই
তার............।
৩
আরেকটু
এগিয়ে রাস্তার ডান মোড় ঘুরতেই
দেখে,
সারি
সারি বাংলো বাড়ি,
সবই
বিরাট ক্যাম্পাসের মধ্যে,
যেখানে
আধিকারিকরা থাকেন।
একটা
বাড়ির গেট থেকে একটা বড় এলসেশিয়ান
কুকুর কে নিয়ে বেরোলো একটি
ছেলে,
হাতে
লাঠি।
কুকুর
টা কে ঠান্ডা থেকে বাঁচানোর
জন্য পেটের উন্মুক্ত অংশ গরম
কাপড় দিয়ে মোড়া।
অনেকেই
পৌষ্য কে,
সন্তান
স্নেহে লালন-পালন
করেন,
দেখে
বেশ ভাল লাগে।
নিজের
ও কিছু পুষতে খুব ইচ্ছে করে
অজন্তার,
তবে
সারাদিন বাড়ির বাইরে থাকে,
ভাবে
তাই যাকে আনবে,
তার
অযত্ন হবে,
তাই
পুষে উঠতে পারেনি আজ অব্দি
কিছু.........।
সারমেয়
চলে যাওয়ার পর,
নজরে
পড়ল বিরাট হিমালয়ান ধনেশ পাখি।
শরীরে
তার এখনো আলস্য,
কিন্তু
খিদের জন্য চলে আসতে হয়েছে
এইখানে।
রোদ
পোয়াচ্ছে সে,
আর
এক-একটা
ফল,
বিরাট
ঠোঁট দিয়ে ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে।
নির্দ্বিধায়
পোজ দিচ্ছে সে।
সুযোগের
সদব্যাবহার করে অজন্তা।
এবার
চোখে পড়ল,
ইলেকট্রিক
তারের উপর বসা হিয়ামালায়ান
বুলবুল পাখিটায়,
কি
সুন্দর বাঁকানো কালো ঝুঁটি
মাথায়।
ক্যামেরা
তাক করে,
জুম
করতে করতে,
সেই
পাখি লাফিয়ে চলে গেল,
পাশের
গাছের ডালে।
সেই
গাছে তাক করতেই,
ফিরে
এলো ইলেকট্রিক লাইনে,
ক্লিক...............
ঝট
করে টিপে দিলো সে শাটার।
এরপর
বাঁশবন,
নানা
রকমের বাঁশ-সোনালি,
মুলি,
চাইনিজ।
সেখানে
উড়ে বেড়াচ্ছে কালো ফিঙে,
যার
শরীর থেকে সূর্যের আলো যেন,
চকচক
করে পিছলে পিছলে যায়।
ফিঙের
দিকে ক্যামেরা তাক করে,
শাটার
টেপার আগেই,
পাখি
উড়তে শুরু করল।
অভিমানী
চোখে তাকালো সে ফিঙের দিকে,
তার
এতো ভালবাসা ওদের প্রতি,
তাও
যে কেন ভয় পেয়ে উড়ে যায়।
সবাই
তো ভালবাসার প্রতিদান পায়না,
এই
ভবে সান্ত্বনা দেয় সে নিজেকে।
সামনের
ঝোঁপে ছোট্ট নীল ‘ভারডিক্ট
ফ্লাইক্যাচার’ পাখি টা কে
দেখে সে এগিয়ে যায়।
কালো
ঠোঁট,
কালো
চোখ নিয়ে,
সে
লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ায় ঘাসের
আর ঝোপঝাড়ের ফাঁকে।
হঠাৎ
পাখি টা লাফিয়ে এসে বসে তার
কাঁধে।
প্রথমে
চমকে যায় অজন্তা,
তারপর
ভাললাগায় মন টা ভরে যায়,
ওকে
চিনেছে তবে এই পাখি।
তারপর
এক অদ্ভুত অনুভূতি,
আস্তে
আস্তে,
তার
শরীর ছোট হয়ে যাচ্ছে,
গলার
কালো ক্যামেরার স্ট্র্যাপটা,
কালো
রেখা হয়ে যায়,
তার
হাত দুটো ছড়িয়ে যায়,
পা
দুটো ছোট হয়ে যায়,
নীল
সালোয়ার কামিজ থেকে নীল ছোট
ছোট পালক শরীর জুড়ে,
ঠোঁট
দুটো ছুঁচলো আর লম্বা হয়ে যায়,
আচমকা
দেখলো,
উড়তে
পারছে সে,
নীল
আকাশে......।
Download and
install Avro Keyboard to view the contents.
Like our
Facebook Page- http://www.facebook.com/phoenix.punoruday
No comments:
Post a Comment