বুড়ি
অতনু
আচার্য্য
- শুভ,
ঘরে আছিস? শুভ...
এই শুভ?
- এইরে!
আবার বুড়িটা ঘরে
এলো।
আমি কোন
রকমে সিগারেট টা নিভিয়ে পড়তে
বসে গেলাম। আমার রুমমেট ও
বন্ধু দীপ দরজাটা খুলে দিল।
- এই দেখ
তোর জন্য কি এনেছি! পাড়ার
উড়ের দোকান থেকে জিলাপি। একদম
গরম গরম ভাজা।
আমি
লাফিয়ে গিয়ে জিলাপির ঠোঙ্গাটা
নিয়ে নিলাম। মিষ্টি আমার খুব
প্রিয়। বাহ! বেশ
দারুণ করেছে তো। দীপ বলল
- ঠাকুমা,
এই তোমার জন্যই বিদেশ
এসেও বেঁচে আছি। তুমি প্রতিদিন
সন্ধ্যায় আমাদের টিফিন খাইয়ে
বাঁচিয়ে রেখেছ।
দীপ টা
সুযোগ পেলেই লোককে তেল মারে
আর কাজ হাসিল করে। নেহাত মিষ্টি
আমার খুব প্রিয়, নাহলে
আমি লাফিয়ে উঠতাম না।
আমরা
দুজনেই মানে আমি আর দীপ থাকি
হাওড়া জেলার উলুবেড়িয়া তে।
কলকাতায় পড়াশোনার উদ্দেশে
আসা। দ্বিতীয় বর্ষের কমার্সের
ছাত্র। বুড়ি, আমাদের
মেসের পাড়ায় থাকেন, বয়স
প্রায় সত্তর বছর। এই মেস এলাকায়
জলের একটু অসুবিধা আছে। খাওয়ার
জল আনতে একটু দূরে পাড়ার মোড়
এ যেতে হয়। তাই হয়ত এই কারনে
এই চত্বরে বাড়ি ভাড়া কম। আমাদেরও
বেশী ভাড়া দিয়ে থাকার সামর্থ্য
নেই। ওই পাড়ার মোড়েই বুড়ির
বাড়ি, একদম টাইম
কলের লাগোয়া। আমরা সকালে বালতি
আর বোতল নিয়ে জল আনতে যাই। উনি
আমাদের হাত থেকে ওগুলো নিয়ে
নেন, আর বলেন ঘুরে
আসো। আমরা এই সুযোগ এ চায়ের
দোকান থেকে ব্রেকফাস্ট করে
চা খেয়ে নিতাম। এসে দেখতাম
আমাদের বালতি বোতল সব ভরা হয়ে
গেছে।
এমনিতে
বুড়ির সবকিছুই ভাল, কিন্তু
এই সন্ধেবেলায় এসে গল্প করাটা
ঠিক পোষায় না। প্রায় ঘণ্টা
দুয়েক বরবাদ করে দেন। পড়াশোনার
এনার্জিটাই চলে যায়। উনি গল্প
শুরু করা মানেই আমরা চুপ হয়ে
যাই। সারাক্ষণ বকবক করতে থাকেন
আর আমার গা জ্বলে যায়। তার উপর
আমার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে
বাবা বাছা করলে আরও অস্বস্তি
হয়। আমার গায়ে যদি নোংরা
জামাকাপড় দেখেন তাহলেই বলবেন,
“কি বাবা, নতুন
জামা নেই? পরে আমি
একটা কিনে এনে দেব”। এই সেদিন
আমি একটা ছেঁড়া সোয়েটার পরে
ঘরে বসেছিলাম, উনি
বলেন কিনা আমাকে একটা সোয়েটার
বানিয়ে দেবেন! আমার
রুমমেট দীপ এই দেখে মুচকি
মুচকি হাসতে থাকে, আর
আমার মাথা গরম হয়ে যায়।
দীপ রাত
জেগে পড়তে পারে এবং পড়ে। কিন্তু
আমি পারিনা। রাত দশটা বাজলেই
দুনিয়ার যত ঘুম আমার চোখে নেমে
আসে, আমি ঘুমিয়ে
পড়ি। আর এই সময়ে দীপ লাইট
জ্বালিয়ে পড়তে বসে। তাই বুড়ির
বকবকের কোন কুফল ওকে ভোগ করতে
হয় না। ইদানীং কালে বুড়ির আমার
প্রতি ভালোবাসাটা আরও বেড়ে
গেছে। এখন কলেজে যাওয়ার আগেও
একবার এসে উপস্থিত হয়, সঙ্গে
রান্না করা কিছু খাওয়ার। “দেখ
শুভ তোর জন্য কি এনেছি!”।
আরও এক ঘণ্টা বরবাদ।
পরীক্ষা
আর মাস দুয়েক বাকি, কিন্তু
সিলেবাসের অর্ধেকও আমার পড়া
হয়নি। যত দিন যাচ্ছে, তত
চাপ বাড়ছে। প্রায় প্রত্যেকদিন
কলেজের স্যারের কাছ থেকে বকুনি
শুনতে হয়। ভাগ্যিস বড় হয়ে
গেছি, স্কুলে
পড়িনা, নাহলে মারও
খেতে হত। স্কুল থেকে বাড়ি
ফিরতে হত পিঠে দাগ নিয়ে। কিন্তু
ক্লাস ভর্তি ছেলে মেয়েদের
সামনে অপমান করা, সেও
তো আরও বেশী কষ্টকর।
দিনটা
ছিল শনিবার, ক্লাসে
স্যার খুব অপমান করলেন পড়া
ঠিকঠাক বলতে পারিনি বলে। স্যার
আমাকে ক্লাস থেকে বের করে
দিলেন, সবার সামনে
আমার মাথা নিচু হয়ে গেল। পরের
ক্লাসগুলো না করেই কলেজ থেকে
বেরিয়ে সোজা রুম এ চলে এলাম।
বহুদিন বাড়ি যাওয়া হয় নি। কলেজ
থেকে সোজা বাড়ি যাব বলে ব্যাগ
গোছানোই ছিল। তবে বাড়ি যেতে
ভাল লাগছে না। মন খুব খারাপ,
ক্লাসের অপমানের
কথা বারবার মনে পড়ছে। কিন্তু
বাড়ি যেতেই হবে, সব
টাকা প্রায় শেষ। এমন সময় বুড়ি
এসে হাজির।
- শুভ
এসেছিস? আজ এত
তাড়াতাড়ি? শুভ...?
দরজাটা খোল, দেখ
তোর জন্য কি এনেছি!!
ডাক টা
শুনেই আমার মাথাটা হটাত করে
গরম হয়ে গেল। আমি দরজা না খুলেই
চেঁচিয়ে বললাম – “যাও তো বুড়ি,
আর জ্বালিও না। তোমার
জন্য আমার পড়াশোনা লাটে উঠেছে।
আর কোনদিনও আমাদের জ্বালাতে
আসবে না। যাও, চলে
যাও এখান থেকে”।
এর
কিছুক্ষণ পরেই আমিও বাড়ির
উদ্দেশে রওনা হলাম। ঠিক সময়ে
বাড়িতে পোঁছালাম। এবারে বাড়িতে
এসে আমার মন টা টিকছে না। বারবার
খালি বুড়ির কথাই মনে পড়ছে।
সন্ধ্যে হলেই কানে ভেসে আসছে
– “শুভ বাড়ি আছিস?”।
ইস, বুড়ি কে ওভাবে
না বললেই ভাল হত। হাজার হোক
উনি বয়স্ক মানুষ। আমাদের কোন
ক্ষতি করেন না, সাহায্য
করেন, ভালবাসেন।
খালি আমাকে একটু বেশিই ভালোবাসেন।
পুরো রবিবার টা আমার খুব খারাপ
কাটল। সোমবার খুব সকালে উঠেই
কলকাতার গাড়ি ধরলাম। উলুবেড়িয়া
থেকে আমাদের মেস আস্তে ঘণ্টা
দুয়েক সময় লাগে। পুরো রাস্তাটাই
বুড়ির কথা ভাবতে ভাবতে চলে
এলাম। ঠিক করলাম রুমে এসেই
আগে বুড়ির সাথে দেখা করব।
রুমে
এসে দেখি, দীপ
এখনও বাড়ি থেকে ফেরেনি। আমি
রুমে ব্যাগ টা রেখেই বুড়ি কে
দেখতে গেলাম। না, আর
ওনাকে বুড়ি বলব না, ঠাকুমা
ই বলব। ওনার বাড়ি যাওয়ার পথে
আমাদের বাড়িওয়ালার সাথে দেখা।
বাড়িওয়ালা জিজ্ঞেস করলেন-
- কি এখন
এলে?
- হ্যাঁ
- তা এখনই
এসে আবার কোথায় যাচ্ছ?
- যাই,
ঠাকুমার সাথে দেখা
করে আসি।
- সে পরে
যাবে, আগে আমার
ঘরে চল। কিছু কথা আছে।
আমি
বাড়িওয়ালার সাথে উল্টো পথে
হাঁটা শুরু করলাম। বুঝলাম,
ভাড়াটা আগেই দিতে
হবে। এই নিয়ে দু-মাসের
ভাড়া বাকি। মেসে পৌঁছেই আমি
আমার ব্যাগ থেকে দু-মাসের
ভাড়াটা বের করে এনে বাড়িওয়ালার
হাতে দিলাম।
- আরে,
এত তাড়াহুড়ো করার
কি দরকার ছিল? পরেই
দিতে। তুমি তো আর চলে যাচ্ছ
না। তাছাড়া আমি তোমাদের চিনি,
তোমরা আমার নিজের
লোকের মত।
- না,
আপনি আমাকে রাস্তা
থেকে ডেকে আনলেন, তাই
ভাবলাম ভাড়া চাইবেন হয়ত।
- বাবা,
আমি বাড়িওয়ালা হতে
পারি, মহাজন নই।
বলেই
উনি হাসতে লাগলেন।
- সে আমি
আগে দিই বা পরে, দিতে
তো হবেই। নাহ, যাই
এবার, ঠাকুমার
সাথে দেখা করে আসি।
এই বলেই
আমি উঠতে যাব এমন সময় উনি আমাকে
থামিয়ে বললেন- “বুড়ি
মারা গেছেন, রবিবার
সন্ধ্যায়”। আমি যেন আকাশ থেকে
পড়লাম। সেকি? কি
করে হল?
- হাই
প্রেশার এর রোগী ছিলেন। হার্ট
অ্যাটাকে মারা গেছেন।
- বাড়িতে
কেউ ছিল না? কেউ
ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় নি?
- তুমি
জানো না? ওনার
বাড়িতে তো কেউ থাকেনা।
এরপর
বাড়িওয়ালা পুরো ঘটনা টা বললেন।
বুড়ি ওই বাড়িতে একাই থাকেন।
ওনার এক ছেলে আর এক মেয়ে। মেয়েকে
হাতিবাগানের এক ব্যবসায়ী
ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছেন। আর
ছেলে ইঞ্জিনিয়ার, বউ
কে নিয়ে সাউথ ক্যালকাটা তে
ফ্ল্যাট এ থাকে। দুজনের কেউ
খোঁজ রাখে না। দুজনকেই ফোন
করেছিলাম। রং নম্বর!! নম্বর
এর কোন অস্তিত্ব নেই।
সম্পত্তি
বলতে তো কিছুই ছিল না। খালি
ওই বাড়িটা, তাও
তিনি ওটা পাঠাগার করার জন্য
দান করে গেছেন। ছেলেকে
ইঞ্জিনিয়ারিং পড়িয়েছেন লোকের
বাড়িতে আয়ার কাজ করে, আর
সেই ছেলে বিয়ে করে মা কে একলা
রেখে চলে গেল। বছর দুয়েক আগে,
ওই বাড়ি দান করার
আগে ছেলে ও মেয়ে শেষবারের মত
এসেছিল। সঙ্গে এনেছিল জামাকাপড়,
মিষ্টি, ফল
আরও কতকিছু। ওই বাড়িটা ওদের
নামে করে দিতে বলেছিল। এখানে
একটা ফ্ল্যাটবাড়ি করবে ও বুড়ি
কে একটা ঘর দেওয়া হবে। বুড়ি
বলে, না, এখানে
পাঠাগার হবে। গরিব বাড়ির ছেলে
মেয়েরা এসে এখানে পড়াশোনা
করবে। ব্যাস, সেই
যে ওরা গেল, আর
এলনা। কোন যোগাযোগ ও রাখল না।
আমি
এতক্ষণ হতবাক হয়ে শুনছিলাম,
ঠাকুমা নেই এটাই
বিশ্বাস হচ্ছিল না। বাড়িওয়ালার
ডাকে আবার সজ্ঞানে এলাম।
- শনিবার
সন্ধ্যাবেলায় বুড়ি এখানে
এসেছিল, তোমাকে
দেওয়ার জন্য একটা প্যাকেট
রেখে গেছেন।
বলেই
বাড়িওয়ালা আমার হাতে একটা
কাগজের প্যাকেট ধরিয়ে দেন।
আর বলেন বুড়ি বলেছিল এটা নাকি
তোমার খুব প্রয়োজন।
আমি
প্যাকেট টা খুলেই আর চোখের
জল আটকে রাখতে পারলাম না।
সজোরে কান্না নেমে এলো আমার
চোখ দিয়ে। প্যাকেটের ভিতরে
একটা পলিথিনের ব্যাগ এ অনেকগুলো
নারিকেল নাড়ু মোড়া আছে। আর
একটা হাতে বোনা সোয়েটার।
সোয়েটার টা আস্তে আস্তে ভিজে
গেল চোখের জলে।
খুব
দুর্বল লাগছিল। হাতে-পায়ে
কোন বল পাচ্ছিলাম না। হটাত
করে হাত থেকে প্যাকেট টা পড়ে
গেল। ঘরের মেঝেতে নাড়ুগুলো
ছড়িয়ে গেল। সোয়েটার টা মেঝের
উপর পড়ে রইল। দেখি নীল রঙের
সোয়েটার এর সামনে দিকে হলুদ
রঙের উল দিয়ে বুনে লেখা আছে-
“শুভ...”।
۞۞۞
Download and
install Avro Keyboard to view the contents.
No comments:
Post a Comment